মনমোহন সিংহের জমানায় সিবিআইকে নিরস্ত করেছিল সলিসিটর জেনারেলের মতামত। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তার অপেক্ষা না করেই আজ রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনকে ভিভিআইপি হেলিকপ্টার কেনা নিয়ে কেলেঙ্কারির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করল সিবিআই। অভিযুক্ত হিসেবে নয়। ৩৬০০ কোটি টাকার ওই দুর্নীতি মামলার অন্যতম সাক্ষী হিসেবে নারায়ণনকে এ দিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিবিআই। রাজভবনে গিয়ে।
ঘটনাচক্রে এ দিনই নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, রাজ্যপালকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে সিবিআই। তবে এমন কাজ এই প্রথম করল সিবিআই। তাদের পরের নিশানা গোয়ার রাজ্যপাল ভারতবীর ওয়াঞ্চু। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এটাও কি তবে মনমোহন জমানায় নিযুক্ত রাজপালদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টির আর এক কৌশল? সিবিআইয়ের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।
সিবিআইয়ের একটি সূত্রের খবর, ব্রিটিশ-ইতালীয় সংস্থা অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ডকে হেলিকপ্টারের বরাত পাইয়ে দেওয়ার জন্য শর্ত বদলের যে অভিযোগ উঠেছে, সেই সিদ্ধান্ত অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে নেওয়া হয় বলে নারায়ণন জানান।
রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যবহারের জন্য অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ডকে প্রায় ৩৬০০ কোটি টাকার হেলিকপ্টারের বরাত দেওয়া হয়েছিল। তাতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, প্রথমে ওই সংস্থাটি হেলিকপ্টারের বরাত পাওয়ার দৌড়েই ছিল না। ভিভিআইপিদের নিয়ে হেলিকপ্টার কত উচ্চতায় উড়তে পারবে, সেই মাপকাঠি ৬ হাজার মিটার থেকে সাড়ে চার হাজার মিটারে কমিয়ে আনার ফলেই অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড বরাত পাওয়ার দৌড়ে চলে আসে। শেষ পর্যন্ত বরাতও পেয়ে যায়। প্রাথমিক তদন্ত বলছে, মনমোহন জমানায় ২০০৫ সালের ১ মার্চের এক বৈঠকে ওই উচ্চতা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নারায়ণন এবং ওয়াঞ্চু দু’জনেই তাতে উপস্থিত ছিলেন। নারায়ণন ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ওয়াঞ্চু ছিলেন তৎকালীন এসপিজি-প্রধান।
সিবিআইয়ের একটি সূত্র বলছে, নারায়ণন জিজ্ঞাসাবাদের সময় জানিয়েছেন, হেলিকপ্টারের উচ্চতা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বাজপেয়ীর জমানায়। ২০০৩ সালে। কোন যুক্তিতে তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র ওই উচ্চতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তারও ব্যাখ্যা করেছেন নারায়ণন। মাত্র একটি সংস্থাই ৬ হাজার মিটার উচ্চতায় ওড়ার মতো হেলিকপ্টার সরবরাহ করতে পারবে বলে জানিয়েছিল। স্বচ্ছতা রাখতে ও অন্যদের সুযোগ করে দিতেই উচ্চতা কমিয়ে সাড়ে চার হাজার মিটার করা হয়। সরকারি ভাবে এ দিন অবশ্য সিবিআইয়ের তরফে নারায়ণনের বক্তব্য নিয়ে কিছু জানানো হয়নি।
তবে তদন্তের বিষয়ের চেয়েও এ দিনের এই জিজ্ঞাসাবাদকে রাজনৈতিক ভাবে বেশি অর্থবহ বলে মনে করছেন অনেকে। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ইউপিএ-জমানায় নিযুক্ত বেশ কয়েক জন রাজ্যপালকে গদি ছাড়ার জন্য চাপ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী ৭ জন রাজ্যপালকে ফোন করে জানতে চান, কেন্দ্রে সরকার বদলের পরে তাঁরা নিজেরাই পদত্যাগ করছেন কি না। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালও তাঁদের মধ্যে ছিলেন। এর পর উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, নাগাল্যান্ডের রাজ্যপাল পদত্যাগ করলেও নারায়ণন করেননি। প্রশ্ন উঠছে, তাই কি সিবিআইয়ের মাধ্যমে চাপ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে?
সিবিআইয়ের বক্তব্য, গত ডিসেম্বর মাস থেকেই রাজ্যপালকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছে সিবিআই। সে সময়ই কেন্দ্রের মনমোহন সিংহের সরকারের কাছে অনুমতি চাওয়া হয়। সরকার তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল গুলাম বাহনবতীর পরামর্শ চায়। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় ফাইল যায় তখনকার সলিসিটর জেনারেল মোহন পরাশরনের কাছে। তিনি কেন্দ্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, কর্মরত রাজ্যপালদের জিজ্ঞাসাবাদ করা ঠিক হবে না। সাক্ষী হিসেবে হলেও রাজ্যপালের পদ ছাড়ার পরেই তাঁদের বয়ান নথিভুক্ত করা যেতে পারে। সিবিআই-প্রধান রঞ্জিৎ সিন্হা অবশ্য দুই রাজ্যপালকে জিজ্ঞাসাবাদ করার বিষয়ে অনড় ছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, রাজ্যপালদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই।
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গত মঙ্গলবার নতুন আটর্নি জেনারেলের কাছে এ বিষয়ে মত চাওয়া চায়। আজ যার ইতিবাচক উত্তর মিলেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ যখন নারায়ণনকে কলকাতায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, ঠিক সেই দিনই নতুন অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতগি জানিয়ে দেন, সিবিআই রাজ্যপালদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে।
সিবিআইয়ের তদন্তকারী দল কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল বা সরকারের সবুজ সঙ্কেতের জন্য অপেক্ষা করেনি। গত কাল রাতেই তারা দিল্লি থেকে কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। আজ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ রাজভবনে যান। সেখানে প্রায় এক ঘণ্টা চলে জিজ্ঞাসাবাদ। নারায়ণনের বয়ান রেকর্ড করা হয়। সেখানেই বয়ানের খসড়া তৈরি হয়। এবং তা রাজ্যপালকে দেখিয়ে নেওয়া হয়। বিকেল পৌনে পাঁচটায় সিবিআই অফিসাররা রাজভবন ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।
সিবিআই সূত্রের বক্তব্য, দিল্লি ফিরে এই দলটিই গোয়া যাবে ওয়াঞ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। হেলিকপ্টার দুর্নীতির তদন্তে নামার সময় দায়ের হওয়া এফআইআরে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ছাড়াও অভিযোগ আনা হয়েছে প্রাক্তন বায়ুসেনাপ্রধান এস পি ত্যাগী ও তাঁর আত্মীয়স্বজন-সহ বেশ কয়েক জনের বিরুদ্ধে। তালিকায় নতুন নাম যোগ হবে কি না, চার্জশিট পেশের সময়ই তা ঠিক হবে বলে সিবিআই সূত্রের বক্তব্য।