ট্র্যাক্টরের খোঁদল। চট পাতা বিছানা। একের পর এক তাঁবুর ভিতরে লঙ্গর। দিল্লি পৌঁছনোর আগে ২৪ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে খোলা আকাশের নীচে যে ‘কৃষি উপনগরী’টি গত এক বছর ধরে গড়ে উঠেছিল, শুক্রবার সেখানে খুশিয়াল হাওয়া। লাড্ডু ও জিলিপির গন্ধে ম ম করছে ব্যারিকেডবন্দি কংক্রিটের জনপদ। মাছি ভনভনে তেপায়াগুলিতে উৎসবের আমেজ।
প্রবল শীত, রোদ, বৃষ্টি, সমালোচনা, পুলিশের মার, সরকারের চোখরাঙানি— সব কিছুকে অগ্রাহ্য করে কৃষকদের বছরভরের চোয়াল কষা লড়াইয়ের সামনে শেষ অবধি মাথা নুইয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
শুক্রবারের সকালটা তাই খুশির রঙ ছড়িয়েছে সিংঘু-টিকরি সীমানার তাঁবুগুলোতে। “অনেক দিন পরে এমন সকাল হল। পুলিশই মোবাইলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা শুনিয়ে অভিনন্দন জানাল আমাদের,” বললেন উত্তরপ্রদেশের রামপুরের বাসিন্দা সন্তোষ সিংহ। ওঁরা আজ খুশি। তা হলে তো আর বিজেপির চিন্তা রইল না উত্তরপ্রদেশে? সামনেই তো ভোট? সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে সন্তোষ এবং তাঁর চারপাশের ভিড় জানিয়ে দিল, “আমরা আজ খুশি ঠিকই। কিন্তু প্রথম কথা হল, টিভিতে শুনে তো কোনও নিশ্চয়তা আসে না। আগে সংসদে এই আইন ফিরিয়ে নেওয়া হোক। তা ছাড়া আরও একটা কথা বলি। এই সিদ্ধান্ত নিতে বড় দেরি করে ফেলল সরকার। মাঝে সাতশো জনের বেশি কৃষক মারা গেল। আসলে কম্বল বেশি ভেজার আগেই শুকিয়ে ফেলা উচিত! না হলে বিস্তর ঝামেলা!”
উত্তরপ্রদেশের ভোটে কী হবে, তা নিয়ে খুবই রূপকধর্মী কথা বললেও দিল্লির সীমানা জানাচ্ছে, সংসদের দুই কক্ষে এই আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আন্দোলন যেমন চলছিল, ঠিক সে রকমই চলবে। যে দিন সরকারি ভাবে আইন খারিজ হবে, সে দিনই সবাই চাটাই গুটিয়ে ঘরমুখো হবে।
গোট আন্দোলনকে যিনি ক্ষুরধার করেছেন, সেই ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েতও আজ বলেছেন, “কৃষকেরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, যতক্ষণ না সংসদে তিন কৃষি আইন ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে। কৃষকদের আজকের এই জয়কে সাড়ে সাতশো শহিদের প্রতি উৎসর্গ করা হল।” পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, “আদিবাসী, কর্মী, মহিলা এবং এই আন্দোলনের যাঁরা অংশীদার, সবাইকেই জানাই অভিনন্দন।” টিকায়েত বলছেন, “এটাও মনে হচ্ছে যে, নির্বাচনের আগে চমক দেওয়ার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে ভাবে মোদী সরকারের জনপ্রিয়তা পড়ছে এবং ভাবমূর্তিতে দাগ লাগছে, এই সিদ্ধান্ত না নিয়ে তাদের উপায় ছিল না।”
সংযুক্ত কিসান মোর্চার পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতেও একই কথা বলা হয়েছে। লখিমপুর খেরির হত্যাকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তির আবেদনও করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, ‘সংযুক্ত মোর্চা প্রধানমন্ত্রীকে এ কথাও মনে করিয়ে দিতে চায়, এই আন্দোলন কেবল মাত্র তিনটি আইন প্রত্যাহারেরই নয়। সমস্ত চাষি যাতে তাঁদের কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য পান, তা নিশ্চিত করার দাবিও রয়েছে আমাদের।’
দিল্লির দূষণ জর্জর বাতাসকে আরও আচ্ছন্ন করে গোটা দিন বাজি ফেটেছে গাজিপুর, সিংঘু সীমানায়। সঙ্গে উদ্দাম ভংড়া নাচ। হট্টগোলের মধ্যেই সর্বভারতীয় কিসান ক্ষেত মজদুর সংগঠনের কর্তা বিজয় কুমার বলছেন, “তা হলে আজ সরকার মেনে নিতে বাধ্য হল যে, যাঁরা আন্দোলন করছিলেন, তাঁরা আসলে কৃষকই! আন্দোলনজীবী নন, খলিস্তানি বা সন্ত্রাসবাদী নন! মোদী এবং যোগী আদিত্যনাথ বারবার এ সব বলে আমাদের অপমান করেছেন। আসলে শুধু দিল্লির সীমানায় নয়, যে ভাবে এই আন্দোলন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গিয়েছিল, তাতে ওরা ভয় পেয়েছে।” তাঁর মতে, “মোদী সরকার যে কিছু কর্পোরেট সংস্থার চৌকিদার, আমাদের নয়, সেটা এক বছর ধরে নিজেরাই প্রমাণ করেছে। এই আইন ফিরিয়ে নিলেও আসন্ন পাঁচ রাজ্যের ভোটে ওরা কোনও ফায়দা পাবে না। উল্টো ফল হবে। আপনারা মিলিয়ে নেবেন।”