Advertisement
E-Paper

মমতার আম-সৌজন্যে মুকুলিত দিল্লি দরবার

ভারত, পাকিস্তান দুই প্রতিবেশী আজও উষ্ণতার খোঁজে ভরসা রাখে আমেই। যুদ্ধের তিক্ততা ভুলে ইন্দিরা গাঁধী-জিয়াউল হক যে আম বিনিময়ের প্রথা চালু করেছিলেন, মনমোহন সিংহ হয়ে বর্তমানে নওয়াজ শরিফ-নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে!

অনমিত্র সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৭ ০৪:৫৫

স্বাদে গন্ধে জুড়ি মেলা ভার। রাজনৈতিক দৌত্যেও!

বাংলার আম। শিষ্টাচারের উপকরণ হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গত কয়েক বছরের মতো এ বারও তাই আম-দৌত্যে সক্রিয় হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি নিজে নেদারল্যান্ডসে থাকলেও তাঁর নির্দেশে বাছাই করা হিমসাগর, ল্যাংড়ারা পৌঁছে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির সাকিনে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দফতর থেকে বিদেশি রাষ্ট্রদূতের দূতাবাসে।

হাল আমলে জিএসটি থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন— নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে তৃণমূলের সংঘাত প্রায় প্রতিটি বিষয়েই। কিন্তু তার সঙ্গে তো সৌজন্যের কোনও বিরোধ নেই! কেন্দ্রের সঙ্গে নীতিগত মতপার্থক্য যতই থাকুক, প্রধানমন্ত্রী তথা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের আম পাঠিয়ে শিষ্টাচার করতে কখনওই পিছপা হননি মমতা।

শুধুই শিষ্টাচার? নাকি, পল্লবিত এই আম্রবার্তায় থেকে গেল আরও অনেক কিছু? ভারত, পাকিস্তান দুই প্রতিবেশী আজও উষ্ণতার খোঁজে ভরসা রাখে আমেই। যুদ্ধের তিক্ততা ভুলে ইন্দিরা গাঁধী-জিয়াউল হক যে আম বিনিময়ের প্রথা চালু করেছিলেন, মনমোহন সিংহ হয়ে বর্তমানে নওয়াজ শরিফ-নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে! এ বছরও কিছু বাছাই লোককে আলফোনসো আম পাঠিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। সূত্রের খবর, প্রাপকের তালিকায় রয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও।

এটিই উপমহাদেশের মোগল ঐতিহ্য। ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্রের মতে, ‘‘আমগাছের পরিচর্যা, সামাজিক অনুষ্ঠানে মনসবদার, রহিসদের মধ্যে আম বিতরণ মোগল আমল থেকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিহারের দ্বারভাঙায় যে আমবাগান তৈরি করেছিলেন আকবর, সেখান থেকে প্রতি বছর সুবেদার, মনসবদারদের আম পাঠানো হতো।’’ সেই মোগল ট্র্যাডিশন পরে লখনউ থেকে মুর্শিদাবাদ, সর্বত্র ছড়িয়ে পরে। ‘‘হিন্দু এবং মুসলমান রহিস আদমি সকলেই আমবাগান করতেন, নিজের বাগানের আম উপহার পাঠাতেন। সেটাই আভিজাত্য দেখাবার কেতা ছিল,’’ বললেন ইতিহাসবিদ। দিল্লিতে আওরঙ্গজেব রোডের নাম যতই বদলে দেওয়া হোক, সেই আম-দরবারের বহুবর্ণ ইতিহাস আজও স্মরণীয়!

কিন্তু আমের মধ্যেই কি নেই অন্য এক রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি? উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা বলেন, একদা মিজোরাম, অরুণাচল, উত্তর-পূর্ব ভারতে অনেক জংলি আম হতো। সেখান থেকেই ফলটি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। আজ ল্যাংড়া না আলফোনসো, হিমসাগর না দক্ষিণের নীলম, কোন আম সেরা, তা নিয়ে হরেক তর্ক। কিন্তু ‘মূলস্রোতের’ ভারত ভুলেও উত্তর-পূর্বের নাম করে না।

চাকরি পেতেও আমের যে কতটা কদর, তা তুলে ধরেছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘পেশোয়ার কী আমির’ গল্পে। যেখানে টেনিদার তিন বার আইএ ফেল করা গাবলুমামা লালমুখো সাহেবের বাত সারিয়ে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছিলেন, স্রেফ ভীষণ টক পেশোয়ারি আম খাইয়ে! আর কে ভুলতে পারে ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ নিবন্ধে বঙ্কিমের সেই অনন্য সাবধানবাণী: ‘সকলে আম্র খাইতে জানে না। কিয়ৎক্ষণ সেলাম-জলে ফেলিয়া ঠান্ডা করিও, যদি জোটে, তবে সে জলে একটু খোশামোদ বরফ দিও।’ হাল আমলে দিল্লির রাজনীতিতে সেলাম জল বা খোশামোদ বরফ কোনও কিছুরই অভাব নেই!

বাংলা জানে, আমের সেরা সমঝদার ছিলেন কোন বাঙালি! তিনি ফজলি আম ফুরোলে কোনও দিনই ফজলিতর আম আনার কথা বলবেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বরং শিলাইদহ থেকে স্ত্রীকে সরাসরি লিখবেন, ‘ভাই ছুটি, আমার আম ফুরিয়ে এসেছে। কিছু আম পাঠিয়ে না দিলে অসুবিধা হবে।’ দেবরাজ ইন্দ্রও তো এই সময়ে বাংলার আম খেতে চান। কৃষ্ণনগরের ভারতচন্দ্র তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্যে লিখছেন, ‘জৈষ্ঠ মাসে পাকা আম এ দেশে বিস্তর/সুধা ফেলে খেতে আশা করে পুরন্দর।’

দেবভোগ্য সেই আমই মমতার সৌজন্যে আজ দিল্লিতে। শাসক দলের পাশাপাশি আম পাঠানো হয়েছে ১০ নম্বর জনপথে, সনিয়া গাঁধীর কাছেও। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে দুই বিরোধী দলের যে কাছে আসা শুরু হয়েছে, তাতে কি এ বারের এই আম-কূটনীতি বিশেষ মাত্রা যোগ করবে!

Mango Mamata Banerjee Narendra Modi Central Government মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy