Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

নোট-আকালে গ্রামে ফেরার উলটপুরাণ

রুজি-রোজগারের আশায় গ্রামের ভিটে ছেড়েছিলেন। ভিন রাজ্যে কাজ করে পেট চলত, গ্রামের বাড়িতেও টাকা পাঠানো হতো। নোট বাতিলের ধাক্কায় এখন তাঁরা ঘরে ফিরছেন।

বাড়ি ফেরা। —নিজস্ব চিত্র

বাড়ি ফেরা। —নিজস্ব চিত্র

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

রুজি-রোজগারের আশায় গ্রামের ভিটে ছেড়েছিলেন। ভিন রাজ্যে কাজ করে পেট চলত, গ্রামের বাড়িতেও টাকা পাঠানো হতো। নোট বাতিলের ধাক্কায় এখন তাঁরা ঘরে ফিরছেন। ফলে গ্রামের অর্থনীতিতে চাপ পড়ছে। একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজের চাহিদা বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওড়িশা, গুজরাত থেকে হরিয়ানা— সব রাজ্য থেকেই এমন রিপোর্ট এসে পৌঁছেছে নরেন্দ্র মোদীর টেবিলে।

নোট-বাতিলের ফলে কোথায়, কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা সরেজমিন খতিয়ে দেখতে রাজ্যে রাজ্যে আমলাদের দল পাঠিয়েছিল কেন্দ্র। এক়-একটি রাজ্যের জন্য তিন জন করে আইএএস অফিসারের দল বাছাই হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সেই আমলারা এ বার দিল্লিতে ফিরে রিপোর্ট জমা করেছেন। সব রাজ্যের রিপোর্ট দেখে সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন, রোজগারের আশায় পূর্ব বা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলি থেকে উত্তর বা পশ্চিম ভারতে যাঁরা পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁরাই আবার কোনও মতে পেট চালানোর চেষ্টায় গ্রামে ফিরছেন। নিজের রাজ্যেও গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়া শ্রমিকরা উল্টো পথ ধরেছেন। সব রাজ্যেই কমবেশি এই ‘রিভার্স মাইগ্রেশন’ বা বিপরীতমুখী স্রোতের ছবি ধরা পড়ছে। এই রিপোর্টের ফলে বিজেপি নেতৃত্বের মধ্যেও উদ্বেগ ছড়িয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যে ভোটে এর প্রভাব পড়তে পারে।

কেন এই উল্টো পথ ধরেছেন খেটে খাওয়া মানুষ?

সরকারি সূত্রের বক্তব্য, মূলত দু’টি কারণ দেখা যাচ্ছে। এক, অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা মূলত কোনও ঠিকাদারের অধীনে বা ছোট-মাঝারি শিল্পে কাজ করেন। এর বেশির ভাগটাই অসংগঠিত ক্ষেত্র। এই সব ঠিকাদার বা সংস্থার মালিকরা তাঁদের মজুরি দিতে পারছেন না। অনেকেই কাজ হারাচ্ছেন বা পুরো মজুরি পাচ্ছেন না। এমনও হয়েছে যে, মজুরি দেওয়া হলেও তা পুরনো ৫০০ টাকার নোটে দেওয়া হচ্ছে। হরিয়ানার গুরুগ্রাম বা ফরিদাবাদের মতো শিল্পাঞ্চল থেকে এ রকম রিপোর্ট মিলেছে। চাপে পড়ে তা-ই নিতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমিকরা। কিন্তু সেই টাকা বাজারে চলছে না।

দ্বিতীয় কারণ হল, ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকরা সাধারণত ব্যাঙ্কে টাকা জমা করেন না। নিজেদের কাছেই নগদ টাকা জমিয়ে রাখেন। যে সব ঠিকাদারের অধীনে কাজ করেন, তাঁদের মাধ্যমেই গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠান। পুরনো ৫০০-১০০০ টাকার নোট আচমকা অচল হয়ে যাওয়ায় তাঁরা গ্রামে টাকা পাঠাতে পারছেন না। অন্য রাজ্যে বসে নিজেদের ঝুলিতে জমানো টাকা ব্যাঙ্কে গিয়ে বদলাতে বা অ্যাকাউন্টে জমা দিতে গিয়েও অসুবিধায় পড়ছেন। সব দিক দেখে তাই গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভাল বলে মনে করছেন তাঁরা।

আমলাদের রিপোর্ট অনুযায়ী— হরিয়ানার গুরুগ্রাম, উত্তরপ্রদেশের নয়ডার মতো দিল্লির আশপাশের এলাকাগুলিতে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ও বিহারের লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নির্মাণ ক্ষেত্রে কাজ করেন। গুরুগ্রামে আবাসন ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ, বিহারের পাশাপাশি উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান থেকেও শ্রমিকরা আসেন। এদের একটা অংশ পাকাপাকি থেকে যান। বাকিরা অগস্ট থেকে আসতে শুরু করেন। থাকেন মার্চ মাস পর্যন্ত। তার পর আবার গ্রামে চাষের কাজ শুরু হলে ফিরে যান। গুজরাতের সুরাত, রাজকোটের অলঙ্কার শিল্পে পূর্ব ভারতের বহু শ্রমিক কাজ করেন। এমনিতেই দীপাবলির পরে অলঙ্কার শিল্পে কাজ কম থাকে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নোট বাতিলের ধাক্কা। ফলে এই সব রাজ্যে কাজ করে পেট চালানো শ্রমিকদের একটা বড় অংশ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ, মালদা, মেদিনীপুর বা হাওড়ার মতো জেলাগুলিতে ফিরে গিয়েছেন।

দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি ঘুরে আমলারা রিপোর্ট দিয়েছেন, ওই রাজ্যগুলিতে উত্তর-পূর্ব থেকে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা বেশি। অসম, মণিপুরের শ্রমিকরা হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, কোচির মতো শহরে কাজ করেন। বড় বড় আবাসন নির্মাণ সংস্থাগুলি কর্মীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু ছোট বা মাঝারি সংস্থাগুলি এখনও নগদে কারবার করতে অভ্যস্ত। তাদের শ্রমিকরা বিপাকে পড়েছেন।

সমস্যা হল, গ্রামে গিয়ে যে রোজগারের উপায় হচ্ছে তা নয়। তাই একশো দিনের কাজের প্রকল্পে মাটি কাটা বা পুকুর খোঁড়ার কাজ করতেই বাধ্য হচ্ছেন ঘরে ফেরা শ্রমিকরা। অর্থ মন্ত্রকের কর্তারা মনে করছেন, মূলত এই কারণেই নভেম্বর মাসে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বিপুল চাহিদা বেড়েছে। যা দেখেই ওই প্রকল্পে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করেছেন অরুণ জেটলি। আমলাদের এই রিপোর্টের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে অর্থনীতির মূল্যায়নকারী সংস্থা ক্রিসিল-এর রিপোর্টও। সেখানেও বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি না শোধরালে ২০১২-তে যত লোক চাষআবাদ বা খেতমজুর হিসেবে কাজ করতেন, ২০১৮-’১৯এ সেই সংখ্যাটা আরও ১ কোটি ২০ লক্ষ বেড়ে যাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cash crunch People Demonetisation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE