সুরাতের নিলামে প্রধানমন্ত্রীর সেই স্যুট। বুধবার। ছবি: পিটিআই।
ক্ষত ঢাকতে গিয়ে কি আরও বেআব্রু হয়ে গেল নরেন্দ্র মোদীর স্যুট-বিড়ম্বনা!
মোদীর নাম লেখা দশ লাখি ওই স্যুট-সহ উপহার হিসেবে পাওয়া সাড়ে চারশো পোশাক-আশাক ও অন্যান্য সামগ্রী আজ নিলামে উঠেছে সুরাতে। চলবে তিন দিন। প্রথম দিনে শুধু কোটেরই দর উঠেছে ১ কোটি ২১ লাখ টাকা। মোদীর ঘোষিত উদ্দেশ্যটি মহৎ, নিলামে পাওয়া টাকায় গঙ্গা সাফাই হবে। কিন্তু সরকার ও নিজের ভাবমূর্তি থেকে বিতর্কের কালি সাফ করার মূল যে উদ্দেশ্য নিয়ে মোদী নিলামে চড়িয়েছেন এই সব উপহার, নতুন-নতুন বিতর্কে সেটাই এখন ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়!
একে তো গত কাল হঠাৎ উদয় হয়ে গুজরাতের এক হিরে ব্যবসায়ী দাবি করেছেন, স্যুটটি তিনিই উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু কোটের দাম কত, সেই রহস্য এখনও প্রকাশ করেননি তিনি। তার উপরে কংগ্রেস তুলেছে একটি মৌলিক প্রশ্ন। অজয় মাকেনের বক্তব্য, গরিবের দেশে প্রধানমন্ত্রী দশ লাখি কোট পরে ঘুরছেন, এটাই লজ্জাজনক। তিনি যে আমিত্বে ডুবে রয়েছেন তা নিয়েও ছিছিক্কার করছে দেশ ও দেশের বাইরের মানুষ। কিন্তু সে কথাও না হয় থাক! দেশের সংবিধানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের আচরণবিধি প্রসঙ্গে স্পষ্ট বলা রয়েছে, কোনও মন্ত্রী পাঁচ হাজার টাকার বেশি দামের উপহার নিতে পারবেন না। নিলে সরকারি তোষাখানায় তার মূল্যায়ন করতে হবে। এবং পাঁচ হাজার টাকার অতিরিক্ত মূল্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে জমা দিতে হবে সরকারি কোষাগারে। কংগ্রেস তাই পাঁচটি প্রশ্ন তুলেছে এ নিয়ে। সেগুলি হল:
• প্রধানমন্ত্রী কি সরকারি তোষাখানায় ৯ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা জমা করেছেন?
• যদি না করে থাকেন, তবে কী ভাবে তিনি ওই স্যুট পরলেন বা তা নিলামের নির্দেশ দিলেন? তা-ও দায়িত্ব দিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে!
• সরকারি আমলারা বা বাকি মন্ত্রীরা এ ভাবে উপহার নিতে শুরু করলে কি প্রধানমন্ত্রী নীরব থাকবেন?
• উপহারের বিনিময়ে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কি কিছু দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী? দিলে তা কী?
ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতারা মানছেন, নিলামের সময়টি বেছে নেওয়ার পিছনে স্পষ্ট একটি রাজনৈতিক ভাবনা ছিল। তা হল, সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনের আগেই বকেয়া কয়েকটি বিতর্ক থেকে সরকারকে সরিয়ে আনা। যাতে গত বারের মতো সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনও ভন্ডুল করে দিতে না পারে এককাট্টা বিরোধীরা। যে কারণে গত কালই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতা খর্বের চেষ্টা বরদাস্ত করবে না তাঁর সরকার। একই সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবার, বিরোধী শিবির ও বারাক ওবামা-সহ আন্তর্জাতিক মহলকেও বার্তা দিয়েছেন মোদী। আর আজ স্যুট নিলামের পিছনেও ছিল একই উদ্দেশ্য। কিন্তু এ ক্ষেত্রে
ফল হল উল্টো। কংগ্রেসের প্রশ্নবাণ মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের ফের এককাট্টা করে তুলতে পারে,
আশঙ্কা তৈরি হয়েছে মোদী, অরুণ জেটলিদের শিবিরে।
দশ লাখি স্যুটে নরেন্দ্র মোদীর নাম।
স্বনাম-চর্চিত ওই স্যুটটা মোদী উপহার পেয়েছিলেন হিরে ব্যবসায়ী রমেশকুমার ভীকাভাই বীরানীর কাছ থেকে। গুজরাতের ওই ব্যবসায়ীই আজ বিষয়টি সংবাদমাধ্যম বিশদ জানিয়ে বিড়ম্বনায় ফেলেছেন মোদীকে। রমেশকুমারের বক্তব্য ‘বড় দাদা’ মোদীকে ছেলে স্মিত বীরানীর হয়ে ওই উপহার দিয়েছিলেন তিনি। জানিয়েছিলেন, ছেলের বিয়েতে প্রধানমন্ত্রী এটি পরে এলে সেটাই হবে সেরা আশীর্বাদ। মোদী তখনই তাঁকে জানান, নানা ব্যস্ততায় ওই বিয়েতে তাঁর যাওয়া হবে না এবং ওই স্যুট তিনি দান করে দেবেন। সেটা ছিল ভাইব্র্যান্ট গুজরাতের সময়। প্রজাতন্ত্র দিবস পর্যন্ত এ নিয়ে কাটাছেঁড়া হয়নি তেমন। বরং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে তাঁর সাজ-সচেতনতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রশংসাই পাচ্ছিলেন মোদী। কিন্তু ২৬ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে ওই পোশাকে প্রকাশ্যে এসেই বিড়ম্বনায় পড়েন প্রধানমন্ত্রী। চিত্র সাংবাদিকরা খেয়াল করেন কোটের পিন স্ট্রাইপে সুতোর বুননে লেখা প্রধানমন্ত্রীর নাম। সংবাদমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। মিশরের স্বৈরাচারী শাসক হোসনি মুবারকের সঙ্গেও তাঁর তুলনা করেন বিরোধীরা। দিল্লি নির্বাচনে রাহুল গাঁধী সেটিকে অস্ত্র করে বলেন, “কালো টাকা উদ্ধার করে গরিবের ব্যাঙ্ক-খাতায় ১৫ লক্ষ টাকা করে দেবেন বলেছিলেন মোদী। প্রধানমন্ত্রী হয়ে এখনও ১৫ আনাও দেননি। আর নিজে তিনি দশ লাখি স্যুট পরে ঘুরছেন।” বিজেপি নেতারাও অনেকে বলছেন, দিল্লিতে হারের জন্য অনেকটাই দায়ী স্যুট-বিতর্ক।
বিরোধীরা এই স্যুটের দাম দশ লক্ষ টাকা বলে মোদীকে কটাক্ষ করে গেলেও এত দিন প্রধানমন্ত্রীর দফতর ছিল নীরব। ক্ষত মেরামতের জন্য মোদী স্যুট-নিলামের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই হঠাৎ কাল সংবাদমাধ্যমে হাজির হন রমেশকুমার। কিন্তু বিতর্ক সামাল দেওয়ার বদলে তা আরও উস্কে দিয়েছেন তিনি। স্যুটটির দাম জানতে চাওয়া হলে তার স্পষ্ট জবাব এড়িয়ে রমেশকুমার বলেন, “ ছেলে জানে। মধুচন্দ্রিমা থেকে ফিরলে আমি জিজ্ঞাসা করব। তবে মনে হয় না, যত টাকা বলা হচ্ছে, তত টাকা দিয়ে এমন একটি স্যুট আমার ছেলে বানাবে।”
স্যুট নিলাম করতে গিয়েও হিতে বিপরীত হচ্ছে বুঝেও বিজেপির মুখপাত্র সুধাংশু ত্রিবেদী আজ বলেন, “জনগণের কাছ থেকে যা আসছে, তা জনগণের স্বার্থেই ব্যবহার করা উচিত, এইন বার্তাই দিতে চেয়েছেন মোদী। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়েও যাবতীয় উপহার নিলামে চড়িয়ে তিনি ৯০ কোটি টাকা তুলেছিলেন। তা মানুষের কাজেই লাগানো হয়েছিল। এ বারও নিলামের টাকা গঙ্গা সাফাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার হবে।”
মওকা পেয়ে আজ মোদীর বিরুদ্ধে ফোঁস করেছে তৃণমূলও। দলের নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেন, “ভাল কাজে প্রধানমন্ত্রীর স্যুট নিলাম হচ্ছে বলে সরকার বার্তা দিতে চাইছে। কিন্তু এটা যে স্রেফ ক্ষত মেরামতের চেষ্টা, তা একটি শিশুও বুঝবে।”
এ দেশের রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রীর পোশাক নিয়ে বিতর্কের ঘটনা বিরল। দিনে দু’বার পোশাক বদলে কংগ্রেস জমানায় সমালোচনার মুখে পড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ খোয়াতে হয়েছিল শিবরাজ পাটিলকে। সে তুলনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিনে তিন বার পোশাক পাল্টেও সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসাই পাচ্ছিলেন। তাঁর সাজ-ঘরানা নিয়ে লেখালেখিও চলছিল। সে সবে একেবার জল ঢেলে দিল ওই এক স্যুট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy