কামাল করতে হো আপ লোগ। খুদ দেতে হো, ফির বাদ মে কহতে হো ইয়ে নহি চলেগা!
একটু গলা চড়িয়েই বলছিলেন ভদ্রমহিলা। টেবিলের উল্টো দিকে বসা দিদিমণি তাঁকে শান্ত করতে সচেষ্ট। বাইরের উঠোনে কচি-কাঁচাদের কোলাহলে কান পাতা দায়। তারই মধ্যে টিচার্স রুমে এই টুকরো কথোপকথন শুনলে মনে হবে, শিক্ষিকা আর অভিভাবকের বিতণ্ডা হয়তো! আসলে টেবিলের দু’দিকে বসা দুই মহিলাই একই পাড়ার বাসিন্দা। এক জন এখন বিএলও (বুথ লেভেল অফিসার), অন্য জন মামুলি ভোটার। নির্বাচন কমিশনের বিশেষ অভিযান তাঁদের দু’দিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!
ভোটার তালিকা সমীক্ষার ফর্ম পূরণ করতে সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র (এপিক) এবং আধার কার্ড সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রুক্মিনী সিংহ। বিএলও তাঁকে বুঝিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তালিকায় যে ১১ রকমের নথির কথা আছে, তার মধ্যে থেকেই কাগজ লাগবে। এপিক বা আধার নয়। বিস্মিত রুক্মিনীর প্রশ্ন, ভোটার তালিকায় তাঁর নাম আছে। কমিশনই তাঁকে এপিক দিয়েছে। এখন আবার চলবে না বললে কী ভাবে চলবে? সমস্যা বুঝে বিএলও আপাতত আধারের প্রতিলিপি জমা করে নিয়েছেন। তবে পরামর্শ দিয়েছেন, স্কুল পাশের শংসাপত্রটা খুঁজে রাখতে।
রাজকীয় মধ্য বিদ্যালয়ের টিচার্স রুমের ভিতরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা এখন বিহারের নানা প্রান্তের নৈমিত্তিক ছবি। যত কাণ্ড চলছে কাগজ নিয়ে। সেই যে বাংলায় গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখে গিয়েছিলেন এবং মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘যদি কাগজে লেখো নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে…’, এখন সে তত্ত্ব অচল! কাগজ আছে তো আপনিও আছেন। কাগজ নেই তো নাম মুছে যাবে! আর এখানে ওখানে লাইন দিয়ে যে সব কাগজপত্র আপনি বানিয়েছেন এবং মহামূল্যবান ধার্য করে রেখেছেন, কমিশন বা কারও না কারও বকলমে রাষ্ট্র ঠিক অন্য একটা কাগজ চেয়ে বসবে!
সংশোধনের ঝোলা নিয়ে অচিরেই সীমানা পেরিয়ে বাংলায় প্রবেশ করার কথা নির্বাচন কমিশনের। বিতর্কের প্রসঙ্গে সবিস্তার যাওয়ার আগে বরং দেখে নেওয়া যাক, বিহারে ঠিক কী ভাবে হচ্ছে বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা পরিমার্জনের (এসআইআর) কাজ। সহজ কথায়, কমিশনের দেওয়া ফর্ম নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন বিএলও এবং তাঁর সহযোগীরা। কমিশনের তৈরি করে দেওয়া সেই ফর্মে আগে থেকেই ভোটারের নাম, ছবি, এপিক নম্বর (যদি থাকে), বিধানসভা কেন্দ্রের নাম ও বুথের নম্বর দেওয়া আছে। সঙ্গে আছে কিউআর কোড। ফর্মে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ভোটার সই করছেন, সঙ্গে উল্লিখিত কোনও নথির প্রতিলিপি দিচ্ছেন। এর পরে বিএলও ওই ফর্ম আপলোড করে দিচ্ছেন কমিশনের অ্যাপ মারফত। কমিশনের তথ্যপঞ্জি ‘আপডেটেড’ হচ্ছে প্রতিদিন।
বাড়িতে গিয়ে যাঁদের পাওয়া যায়নি, তাঁরা বিএলও-র কাছে এসে ফর্মের কাজ সেরে যেতে পারেন। প্রতি মহল্লায় ফেস্টুন-পোস্টার দিয়ে বিএলও-র সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দেওয়া থাকছে। যে হেতু বিএলও-রা বেশির ভাগই এলাকার স্কুল শিক্ষক, তাঁরা স্কুলেই বসে পরিমার্জনের পরবর্তী অংশ সেরে নিচ্ছেন। দুয়ারে কমিশন পৌঁছে বেশির ভাগ কাজ করে নেওয়ায় স্কুলে বা সেন্টারে এখন তেমন ভিড় নেই। বাইরে থাকা ভোটারদের জন্য অনলাইনে ফর্ম দেওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। এক মাস ধরে চলার পরে এই সংশোধনের প্রথম ধাপ শেষ হচ্ছে ২৫ জুলাই।
সেই সময়সীমা ফুরনোর ৪৮ ঘণ্টা আগে, অর্থাৎ বুধবার পর্যন্ত বিহারের ৯৮% ভোটারের কাছে সংশোধন অভিযান পৌঁছতে পেরেছে বলে কমিশনের বক্তব্য। মোট ৭ কোটি ১৭ লক্ষ ভোটারের ফর্ম কমিশনের কাছে জমা হয়েছে। কমিশনের তরফে বলা হচ্ছে, ২০ লক্ষ মৃত, ২৮ লক্ষ স্থায়ী ভাবে স্থানান্তরিত এবং একাধিক জায়গায় ভোটার তালিকায় নাম থাকা ৭ লক্ষ ভোটারের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। আর প্রায় এক লক্ষ ভোটার আছেন, যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। যোগ করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়াচ্ছে ৫৬ লক্ষের বেশি। এ ছাড়া সব মিলিয়ে ফর্ম নিয়েও জমা দেননি এখনও ১৫ লক্ষ ভোটার। বিহারের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) বিনোদ সিংহ গুঞ্জিয়ালের দফতর থেকে সব রাজনৈতিক দলের (স্বীকৃত ১২টি দল) জেলা নেতৃত্বের কাছে বার্তা পাঠানো হচ্ছে, ‘নিখোঁজ’দের খুঁজে দিতে বিএলএ (বুথ লেভল এজেন্ট)-দের যেন তাঁরা কাজে লাগান।
বিরোধী দলের নেতাদের প্রশ্ন, কমিশনের তাড়াহুড়োর বন্দুক তাঁদের কাঁধে রাখা হবে কেন! প্রশ্ন আছে আরও।
(চলবে)
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)