Advertisement
০২ মে ২০২৪

তৎপর ভারতের প্রশংসায় রাষ্ট্রপুঞ্জ

এক-একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে মোটামুটি দস্তুর হল, প্রাণহানি এড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের ‘ব্যর্থতা’-র সমালোচনা। ফণীর পরে কিন্তু প্রশংসা পাচ্ছে প্রশাসন। মার্কিন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের লিঙ্ক হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছে সকাল থেকেই, যার শিরোনাম— ‘দশ লক্ষ মানুষকে সাইক্লোনের হাত থেকে কী ভাবে বাঁচাবেন? ভারতের এক গরিব রাজ্যের কাছে জেনে নিন।’

ভিটেহারা: ফণীর জেরে ঠাঁই মিলেছে রাস্তায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

ভিটেহারা: ফণীর জেরে ঠাঁই মিলেছে রাস্তায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৯ ০৩:৩২
Share: Save:

রাজ্যের সাড়ে চার কোটি মানুষকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন নবীন পট্টনায়ক। ঘূর্ণিঝড় ফণী ওড়িশায় আছড়ে পড়ার বহু আগে থেকে সরকারি-বেসরকারি যে কর্মীরা, স্বেচ্ছাসেবীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন উদ্ধারকাজে, এমনকি যাঁরা সরকারের ভরসায় উঠে এসেছিলেন সাইক্লোন সেন্টারের অস্থায়ী ঠিকানায়— সবাইকেই ধন্যবাদ মুখ্যমন্ত্রীর। বলছেন, ‘‘মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ১২ লক্ষ মানুষকে সরানো গিয়েছে। ইতিহাসে কখনও হয়নি।’’

এক-একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরে মোটামুটি দস্তুর হল, প্রাণহানি এড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের ‘ব্যর্থতা’-র সমালোচনা। ফণীর পরে কিন্তু প্রশংসা পাচ্ছে প্রশাসন। মার্কিন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের লিঙ্ক হোয়াটসঅ্যাপে ঘুরছে সকাল থেকেই, যার শিরোনাম— ‘দশ লক্ষ মানুষকে সাইক্লোনের হাত থেকে কী ভাবে বাঁচাবেন? ভারতের এক গরিব রাজ্যের কাছে জেনে নিন।’ খোদ রাষ্ট্রপুঞ্জের কর্তারা বলেছেন, ‘‘এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কী ভাবে প্রাণহানি কমানো যেতে পারে, সেই পথ দেখাল ভারত।’’

কী রকম পথ? রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘বিপর্যয়ের ঝুঁকি প্রশমন বিভাগ’-এর প্রধান মামি মিজ়ুটোরির বিবৃতি বলছে, ‘‘একটিও মৃত্যু হতে না-দেওয়ার মনোভাব নিয়ে কাজ করেছে ভারত। ২০১৫ সালের ‘সেনডাই পরিকাঠামো’ প্রয়োগের ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ’’ জাপানের সেনডাইয়ে গৃহীত ওই চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল, বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উপরে প্রধান দায়িত্ব থাকলেও প্রাদেশিক সরকার, বেসরকারি ক্ষেত্র ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষকেও তাতে শামিল করা হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই বিভাগটির মুখপাত্র ডেনিস ম্যাকক্লিনের কথায়, ‘‘ভারতের আবহাওয়া দফতর যে ভাবে খুঁটিনাটি পূর্বাভাস মিলিয়ে দিয়েছে, তাতে এত লোককে নিরাপদ আশ্রয়ে সরানোর কাজটাও অনেক আগে থেকে করা গিয়েছে।’’

ওড়িশার ত্রাণ কমিশনার বিষ্ণুপদ শেট্টির কথায়, ‘‘এক দিন কিছু হয়নি। আমাদের কাজটা কুড়ি বছর ধরে চলছিল।’’ ‌১৯৯৯-এর সুপার সাইক্লোনে প্রায় দশ হাজার মানুষের মৃত্যুর পরেই আইআইটি খড়্গপুরের সাহায্যে ওড়িশায় তৈরি হয়েছিল কয়েকশো সাইক্লোন সেন্টার। গত ক’দিনেও উদ্ধারকাজের মহড়া হয়েছে লাগাতার। আর কী কী ছিল নবীনের ‘টিম ওড়িশা’-তে? ৪৩,০০০ স্বেচ্ছাসেবী, ১,০০০ বিশেষ আপৎকালীন কর্মী, গোটা রাজ্যের পুলিশবাহিনী, ৩০০ মোটরবোট, দু’টো হেলিকপ্টার। আর দমকল তো আছেই। উপকূল এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করতে এই ক’দিনে ২৬ লক্ষ এসএমএস পাঠিয়েছে রাজ্য সরকার। টিভি-তে, লাউডস্পিকারে স্থানীয় ভাষায় বেজে গিয়েছে— ‘‘ঝড় আসছে, সরে যান।’’ যাঁরা এর পরেও বাড়ি ছাড়তে চাননি, তাঁদের ধমক দিয়ে বাসে তুলে সাইক্লোন সেন্টারে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ। সেখানে আগে থেকেই মজুত ছিল পর্যাপ্ত খাবার ও জল। টুইটারের ছবিতে দেখা গিয়েছে, মোটরবাইক চালিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে দুই গৃহবধূকে উদ্ধার করে আনছেন পুলিশের মহিলা অফিসার। সরকারি কর্তারা জানাচ্ছেন, তাঁরা আরও খুশি হতেন যদি এ বারের ১৬টি প্রাণহানিও এড়ানো যেত।

নবীন আজ বলেছেন, ‘‘ফণী ছিল বিরল ধরনের গ্রীষ্মকালীন ঘূর্ণিঝড়। তাই সেটি ভূ-খণ্ডে ঢোকার ২৪ ঘণ্টা আগে পর্যন্তও বোঝা যায়নি, কোন পথে ঝড় যাবে। চ্যালেঞ্জটা ছিল সেখানেই।’’ আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা ও বড় ধরনের প্রাণহানি রুখতে পারায় খুশি দিল্লির মৌসম ভবন। আজ সংস্থার ‘ন্যাশনাল ওয়েদার ফোরকাস্টিং সেন্টার’-এর অন্যতম প্রধান কে সাথী দেবী বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যে প্রযুক্তি রয়েছে, তাতে তো ঝড় থামানো সম্ভব নয়। কিন্তু অন্তত আগেভাগে মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে প্রাণহানি রোখা সম্ভব।’’ আবহাওয়া দফতরের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, যথেষ্ট সময় হাতে রেখে নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে পারাটাই কাজে এসেছে এ যাত্রা। তাঁর কথায়, ‘‘আয়লার সময়ে বড়জোর ৪৮ ঘণ্টা আগে সবটা বলা গিয়েছিল। ফণীর ক্ষেত্রে পাঁচ দিন আগে পূর্বাভাস হয়েছে।’’

তৎপর ছিল কলকাতার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের ডজনখানেক জেলার প্রশাসন। পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রাথমিক ভাবে ৭,০৯৯ জন মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরানোর পরিকল্পনা থাকলেও শুক্রবার রাত পর্যন্ত সরানো হয় ৫২,২৯৭ জনকে। ঝাড়গ্রাম জেলায় ৮২টি ত্রাণ শিবিরে ৬৫৪১ জনকে সরানো হয়েছিল। মুর্শিদাবাদে ১১২টি শিবিরে রাখা হয় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার বাসিন্দাকে। হুগলির চারটি নদী-বাঁধে বসবাসকারী, এমনকি গ্রামগুলির সব মাটির বাড়িতে থাকা পরিবারগুলিকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হয়। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন ব্লক থেকে অন্তত ২৫ হাজার মানুষকে সরানো হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় উদ্ধার করা হয় নদী ও সমুদ্র লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা প্রায় ন’হাজার মানুষকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Fani ফণী UN United Nations
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE