বাম-কংগ্রেস জোট এমনিতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তার উপরে বিধানসভা ভোট শুরুর দশ দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের এক কিস্তি মহার্ঘভাতা (ডিএ) ঘোষণা আরও বাড়িয়ে দিল তাঁর রক্তচাপ। ডিএ বকেয়ায় দেশের শীর্ষস্থান দখল করে ফেলা রাজ্যে কোন যুক্তিতে খয়রাতির বন্যা বইয়ে দেওয়া যায়, কর্মীমহল সেই প্রশ্নে উত্তাল।
কেন্দ্রের ১ কোটি ৮ লক্ষ কর্মী ও পেনশনভোগীর জন্য ‘দোলের উপহার’ হিসেবে বুধবার এক কিস্তি (৬%) ডিএ ঘোষণা করেছে মোদী সরকার। পরিণামে ডিএ প্রাপ্তির দৌড়ে কেন্দ্রীয় কর্মীদের তুলনায় রাজ্য সরকারি কর্মীরা ৫০% পিছিয়ে পড়েছেন। অর্থাৎ, ডিএ ঘাটতিতে ফের ‘হাফ সেঞ্চুরি’ করেছে পশ্চিমবঙ্গ। স্বাধীনতার পরে এ নিয়ে দ্বিতীয় বার। প্রথম অর্ধশতকের (৫৪%) কৃতিত্বটি অবশ্য তৃণমূল সরকারেরই ঝুলিতে।
এই সুবাদে বাংলার ‘জয়জয়কার’ ডিএ বকেয়ার ময়দানে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যে ক’টি রাজ্য ভোটে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে তো বটেই, বকেয়া-তালিকায় সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম। কেন্দ্রের সাম্প্রতিক ঘোষণার আগে পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা, গুজরাত, কেরল, কর্নাটক, তামিলনাড়ুর মতো ১৫টি রাজ্যে ডিএ বকেয়া ছিল না। এখন তাদের ঘাটতি হল ৬%। পঞ্জাব, অসম, মহারাষ্ট্রের মতো কিছু রাজ্য ১২% পিছিয়ে পড়ল।
পশ্চিমবঙ্গে ঘাটতির বহর ৫০% ছুঁয়ে ফেলায় শাসক দলের অন্দরে কাঁপুনি ধরেছে। তৃণমূলের বড় অংশের বক্তব্য, ৫০% ডিএ পাওনা থাকা মানে প্রাপ্য বেতনের কার্যত অর্ধেক হাতে পাওয়া। রাজ্যে সরকারি কর্মী ও পেনশনভোগী প্রায় দশ লক্ষ। তাঁদের পরিবারকে ধরলে ভুক্তভোগীর সংখ্যাটা অন্তত ৫০ লক্ষে দাঁড়ায়। এই ‘বঞ্চনা’র ক্ষোভ ভোটের অঙ্কে প্রভাব ফেলার আশঙ্কায় তৃণমূলের একাংশ।
দলেরই এক শীর্ষ নেতা তথা মন্ত্রীর আক্ষেপ, ‘‘পাঁচ বছরে মেলা-খেলা-উৎসব, ক্লাব-অনুদান ইত্যাদি খয়রাতিতে আমরা হাজার কোটি টাকা বিলিয়েছি। চোলাই মদে মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ দিয়েছি। এখন মনে হচ্ছে, কর্মীদের পাওনার দিকটা এত উপেক্ষা না করলেই হতো।’’ বস্তুত মহার্ঘভাতা প্রাপ্তিতে বহু দিনই রাজ্যের কর্মীরা পিছিয়ে। এ অবস্থায় বিস্তর টালবাহানার পরে রাজ্য সরকার ষষ্ঠ বেতন কমিশন গড়েছে। তাতে কিছুটা সুরাহা হবে বলে আশায় ছিলেন কর্মীরা। কারণ, বেতন কমিশনের শুরুতে অন্তর্বর্তিকালীন ভাতা ঘোষণার চল আছে। কমিশনের তরফে কিন্তু এখনও তেমন সাড়া নেই।
পরিণামে কর্মীদের ক্ষোভ দিন দিন বেড়েছে বই কমেনি। বুধবারের কেন্দ্রীয় ঘোষণা শুনে যা তুঙ্গে। ‘‘পাঁচ বছর ধরে শুধু প্রতিশ্রুতি! বকেয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মাথাব্যথাই নেই! ভাবছি, এ বার কোর্টে যাব।’’— বলেছেন আইএনটিইউসি অনুমোদিত কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ-এর নেতা মলয় মুখোপাধ্যায়। বাম সমর্থিত কো-অর্ডিনেশন কমিটির মনোজ গুহ বলেন, ‘‘সরকারের পরিবর্তন চাই।’’ অন্য এক বাম সংগঠনের নেতা সঙ্কেত চক্রবর্তীর মন্তব্য, ‘‘শাসক দল ফল টের পাবে ভোটের বাক্সে।’’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারি কর্মচারী ইউনিয়নের বিপুল রায় বলেন, ‘‘যৌথ কর্মচারী আন্দোলন গড়ে তোলাই একমাত্র উপায়।’’
হাতিয়ার পেয়েছেন বিরোধীরাও। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, ‘‘এই সরকার নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এক দিকে ডিএ-তে রেকর্ড বকেয়া, অন্য দিকে বাজার থেকে হিমালয়সমান ধার!’’ প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যর দাবি, ‘‘এত দিন নানা উৎসবে ডিএ-র টাকা যথেচ্ছ খরচ হয়েছে। কর্মীরা নিশ্চয় আন্দোলনে নামবেন।’’ রাজ্য কর্মীদের উদ্দেশে বিজেপি’র সরকারি কর্মচারী পরিষদের নেতা দেবাশিস শীলের আবেদন, ‘‘তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিন।’’
শাসকপন্থী কর্মীদের একাংশও হতাশা গোপন রাখছেন না। তৃণমূল সমর্থিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের নেতা সৌম্য বিশ্বাস অবশ্য বিষয়টিকে আশাবাদের মোড়কে ঢাকছেন। ‘‘বিদায়ী সরকারের কাছে আমরা একাধিক বার বকেয়া ডিএ-র দাবি জানিয়েছি। আশা করছি, নতুন সরকার সহৃদয়তার সঙ্গে বিচার করবে।’’ আর তৃণমূলের মহাসচিব তথা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘এটাকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা সুবিধা পাবে না। সীমিত আর্থিক সাধ্যের মধ্যেও সরকার সব অংশের মানুষের জন্য যথাসাধ্য করেছে।’’ তবে এখন নির্বাচনী আচরণবিধি জারি থাকায় নতুন কোনও ঘোষণা যে সম্ভব নয়, পার্থবাবু তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ ডিএ’র ক্ষতে প্রলেপ পড়ার আশু সম্ভাবনা নেই।
এমন পরিস্থিতি হল কেন? মমতা সরকারের নীতির দিকেই আঙুল তুলছে নবান্নের একাংশ। তাদের বক্তব্য: বছরে দু’কিস্তি ডিএ দেওয়াটা প্রথা। বাম আমলেও সেই ধারা বজায় ছিল। কিন্তু মমতা ঠিক করেছেন, বছরে এক কিস্তি ডিএ দেওয়া হবে। অর্থ দফতরের খবর, গত পাঁচ বছর ধরে রাজ্য বাজেটে বেতন-পেনশন বাবদ যা বরাদ্দ, তাতে বছরে এক কিস্তির বেশি ডিএ দেওয়া সম্ভবও নয়।
ফল যা হওয়ার তা-ই। ২০১১-য় (বাম জমানার শেষ বছর) যেখানে কেন্দ্র-রাজ্য ডিএ’র ফারাক ছিল ১৬%, এখন সেটাই ৫০%। মুখ্যমন্ত্রী আগে নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কখনও বাম সরকারের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে বলেছেন, ‘‘ওদের করা বিপুল দেনার খেসারত আমাদের দিতে হচ্ছে। ঋণ শোধ খাতে ফি মাসে ২৮ হাজার কোটি টাকা কেটে নিচ্ছে কেন্দ্র।’’ এ-ও দাবি করেছেন, ওই টাকা কাটা না পড়লে তিনি কর্মীদের যাবতীয় বকেয়া মিটিয়ে দিতেন।
এ ব্যাপারে একটি বিশেষ তহবিল গড়ার দাবিও কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনে পেশ করেছে রাজ্য। কিন্তু ঋণ তো সব রাজ্যেরই থাকে। ‘‘তাই বলে সকলে কি এত পাওনা ফেলে রাখে?’’— প্রশ্ন তুলছেন কর্মীরা। জবাব দিতে গিয়ে থই পাচ্ছেন না কর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy