Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
National News

ভারতে তাঁর প্রথম দেহরক্ষীকে দেখে আবেগাপ্লুত দলাই লামা

৫৮ বছর তিন দিন আগের সেই স্মৃতি তাঁর মনে এখনও টাটকা। কিন্তু নোবেলজয়ী, অশীতিপর ধর্মগুরুও যে তাঁকে মনে রাখবেন, ৫ নম্বর আসাম রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার নরেনচন্দ্র দাস তা ভাবতেও পারেননি।

নরেনচন্দ্র দাসকে জড়িয়ে ধরলেন দলাই লামা।

নরেনচন্দ্র দাসকে জড়িয়ে ধরলেন দলাই লামা।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ১৬:০২
Share: Save:

৫৮ বছর তিন দিন আগের সেই স্মৃতি তাঁর মনে এখনও টাটকা। কিন্তু নোবেলজয়ী, অশীতিপর ধর্মগুরুও যে তাঁকে মনে রাখবেন, ৫ নম্বর আসাম রাইফেলসের অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার নরেনচন্দ্র দাস তা ভাবতেও পারেননি। কিন্তু ভারতে তাঁর প্রথম দেহরক্ষী নরেনবাবুকে দেখেই যে ভাবে বুকে টেনে নিলেন দলাই লামা, তার পর কি আর চোখের জল বাধ মানে!

নরেনচন্দ্র দাস তখন মাত্র বছর তিনেক চাকরি পাওয়া জওয়ান। পোস্টিং তাওয়াংয়ে। বুম লার নিয়ন্ত্রণরেখায় এখনকার মতো কড়াকড়ি নেই। ১৯৫৯ সালের ২৯ মার্চ খবর পেলেন, তিব্বত থেকে ধর্মগুরু পালিয়ে আসছেন তাওয়াংয়ে। পিছনে ধাওয়া করছে চিনা বাহিনী। সেই গুরুকে পাহারা দিয়ে পৌঁছে দিতে হবে নিরাপদ ভূখণ্ডে। নরেন ও তাঁর সঙ্গী জওয়ানরা তখনও সীমান্ত থেকে এক দিনের দূরত্বে। আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাতকারে নরেন বলতে থাকেন সেই দিনের কথা। এখনকার মতো রাস্তাও ছিল না তখন। তাই দৌড় শুরু। তখনও বুমা লায় শেষ হত না ভারতের সীমা। বুম লা থেকেও ভিতরে অনেকটা ঢুকে গিয়ে দেখলেন খচ্চর আরোহী এক মুণ্ডিত মস্তক দীর্ঘদেহী ব্যক্তি ও তাঁর সঙ্গীরা ভারতের আহ্বানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ৩০ মার্চ তিব্বতের ভিতর থেকে ভারতের সীমায় দলাই লামার যাত্রা শুরু হল। খোদ দলাই লামার দেহরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন নরেনবাবু। তিব্বতি প্রতিনিধিদের প্রহরায় ছিলেন আসাম রাইফেলসের জনা তিরিশেক জওয়ান। তাওয়াং পেরিয়ে দলাই লামাকে লুমলা পৌঁছে দিয়ে প্রথম দলের দায়িত্ব শেষ হল।

আরও পড়ুন

তাওয়াং-এ ভারত ট্রেন পাঠালে ফল খারাপ হবে: আবার হুঁশিয়ারি চিনের

১৯৮২ সালে অবসর নেওয়া নরেনবাবু এত বছরের ব্যবধানে গুয়াহাটিতে ফের দলাই লামার সাক্ষাত পেলেন। এ দিন নমামি ব্রহ্মপুত্রে যোগ দিতে আসা দলাই লামার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন নরেনবাবু। কিন্তু তাঁর পরিচয় দেওয়ার আগেই, মঞ্চে আসাম রাইফেলসের ডিজি এস চৌহানকে দেখে দলাই লামা নিজে বলে ওঠেন, “আপনার বাহিনীই আমায় ভারতে নিয়ে এসেছিল। এখনও সে দিনের কথা মনে পড়ে।” চৌহান তাঁকে জানান, সে দিনের এক জওয়ান প্রেক্ষাগৃহে আছেন। কাঁপা পায়ে মঞ্চে ওঠেন নরেনবাবু। জীবনে প্রথম। ব্যাগ্র দলাই লামা নরেনবাবুকে বুকে টেনে নেন। প্রায় মিনিট দুয়েক পরে আলিঙ্গনমুক্ত হন নরেনবাবু। “ওই দুই মিনিটই আমার জীবনের সেরা সময়”- বলে ওঠেন প্রবীণ, পোড়খাওয়া ধর্মগুরু। দুই প্রবীণই তখন পৌঁছে গেছেন ৫৮ বছর আগে। দলাই লামা পুরোন বন্ধুকে বলেন, “আপনাকে দেখে যেমন ভাল লাগছে, তেমনই আপনার মুখের বলিরেখা দেখে মনে পড়ছে, আরে, আমিও তো অনেক বুড়ো হয়ে গেলাম।”

অনুষ্ঠান শেষে নরেনবাবুকে আরও এক বার মঞ্চে ডেকে নিয়েছিলেন দলাই লামা। স্যালুট করেন তাঁকে। জানতে চান পরিবারের কথাও।

এ দেশে নিজের প্রথম দেহরক্ষী ও পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দলাই লামা।

সে দিনের কথা বলতে গেলে এখনও চোখ চকচক করে ওঠে নরেনবাবুর। বলেন, “তখনও বুঝতে পারিনি কত বড় ইতিহাসের সাক্ষী থাকলাম আমরা। পরে বুঝেছিলাম ওই মানুষটার গুরুত্ব কত। এত দিন পরে ফের তাঁকে কাছ থেকে দেখে কী যে উত্তেজিত বোঝাতে পারব না।” একেবারে ঝকঝকে উর্দিতে গর্বিত নরেনবাবু বলছিলেন, “তখনও তো রাস্তা ছিল না। কখনও হেঁটে, কখনও খচ্চরে এসেছিলেন ওঁরা। পরে দুই দেশে যুদ্ধ হল। বুম লায় তৈরি হল সীমান্তরেখা। শত্রুতা বাড়ল সীমান্তে। অবশ্য যুদ্ধের সময় আমি সীমান্তে ছিলাম না। ফুটবল খেলার জন্য বিভিন্ন জায়গা ঘুরছি। পরে সীমান্ত প্রহরার দায়িত্বও ইন্দো তিব্বত সীমান্ত পুলিশকে দিয়ে দেওয়া হল। সরে এলাম আমরা।”

চার মেয়ে, তিন ছেলেকে নিয়ে ৭৬ বছর বয়সী নরেনবাবুর সংসার তেজপুরের বালিপাড়ায়। চিন যুদ্ধের সময় ওই পর্যন্তও দখল করে নিয়েছিল চিনা বাহিনী। এ দিন দলাই লামা যখন মঞ্চে শান্তির বাণী ছড়াচ্ছেন, অবসরপ্রাপ্ত আধা সেনা জওয়ান বলেন, “মানুষটা গোটা জীবন শান্তির কথা বললেন, কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করেই দু’দেশে অশান্তি আর থামছে না। জমি দখল আর অযথা প্রাণহানির অসারতা কবে যে মানুষ বুঝবে।”

ছবি: রাজীবাক্ষ রক্ষিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE