Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
IRCTC Food Services

রেলের খাবারে এ বার ‘টিকটিকি-বিরিয়ানি’!

খিদে পেটে প্যাকেটবন্দি বিরিয়ানি কয়েক গ্রাস খাওয়ার পরেই তাঁর অক্কা পাওয়ার জোগাড়! বিরিয়ানিতে আস্ত একটা মরা টিকটিকি!

পূর্বা এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রির বিরিয়ানিতে মরা টিকটিকি মিলল।

পূর্বা এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রির বিরিয়ানিতে মরা টিকটিকি মিলল।

উজ্জ্বল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৭ ১৭:১৫
Share: Save:

এক সপ্তাহও কাটেনি। ট্রেনে খাওয়ার অযোগ্য খাবার পরিবেশন নিয়ে রিপোর্ট পেশ করেছে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। তার মধ্যেই এ বার পূর্বা এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রির বিরিয়ানিতে ভাজা টিকটিকি মিলল। আর সেই ‘টিকটিকি-বিরিয়ানি’ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এক যাত্রী। মঙ্গলবার দুপুরের এই ঘটনা ফের বুঝিয়ে দিল, সিএজি-র রিপোর্ট কতটা বাস্তব ছিল। এবং রেলের খাবার যেমন ছিল, রয়েছে তেমনই। কিছুই পাল্টায়নি!

বর্ধমান থেকে উত্তরপ্রদেশের তুন্ডলায় যাবেন বলে বুধবার পূর্বা এক্সপ্রেসের বাতানুকূল এইচএ-১ কামরায় উঠেছিলেন সন্তোষকুমার সিনহা নামে এক যাত্রী। দুপুরের খাবারটা রেলের প্যান্ট্রিতেই অর্ডার দিয়েছিলেন। বিরিয়ানি। মোকামা স্টেশনে খিদে পেটে প্যাকেটবন্দি বিরিয়ানি হাতে পেয়ে খেতেও শুরু করেছিলেন। কিন্তু, কয়েক গ্রাস খাওয়ার পরেই তাঁর ‘অক্কা’ পাওয়ার জোগাড়! বিরিয়ানিতে আস্ত একটা মরা টিকটিকি! কোনও রকমে সেই প্যাকেট ফেলে ট্রেনের বেসিনে ছুটে যান সন্তোষ। বমি করেও স্বস্তি না মেলায় কর্তব্যরত টিকিট পরীক্ষককে শরীর খারাপের কথা জানান। খবর যায় কন্ট্রোল রুমে। প্যান্ট্রি-ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ করার পাশাপাশি টিকটিকি-সহ বিরিয়ানির ছবি রেল মন্ত্রকের টুইটার হ্যান্ডলে পোস্ট করেন সন্তোষবাবুর এক সহযাত্রী মেঘনা সিনহা। মন্ত্রক থেকে দানাপুর ডিভিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কয়েক স্টেশন পেরিয়ে সন্তোষবাবুর চিকিত্সার ব্যবস্থা করে রেল।

রেল সফরে এমন অভিজ্ঞতা মোটেও বিরল নয়। বারে বারেই রেলের খাবার নিয়ে যাত্রীরা অভিযোগ জানিয়েছেন। তা সে খাবারের মান হোক বা পরিমাণ, প্যান্ট্রি কর্মীদের ব্যবহার হোক বা খাবারের দাম— অভিযোগ ভূরি ভূরি। প্রতি দিন জমা পড়ে। রেল তার একটা অংশ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়। তার পর যে কে সেই! কোনও ফারাক তৈরি হয় না। যেমন, এ ক্ষেত্রেও নেওয়া হয়ছে। কী রকম?

পূর্ব-মধ্য রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক রাজেশ কুমার বলেন, ‘‘ওই যাত্রীকে প্যান্ট্রি থেকে যে বিরিয়ানি দেওয়া হয়েছিল, তাতে একটা মরা টিকটিকি ছিল। ট্রেনের মধ্যেই ভদ্রলোকের শরীর খারাপ হয়। ট্রেনটি ঝাঝা পৌঁছনোর পর আমরা খবর পেয়ে চিকিত্সকের ব্যবস্থা করি। গোটা ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। পূর্বা এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রির দায়িত্বে থাকা সংস্থাটির চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।’’ কিন্তু, চুক্তি বাতিল করলেই কি সমস্যা মিটবে? জবাব দিতে চাননি রাজেশ। তাঁর কথায়, ‘‘এর বেশি আমার জানা নেই।’’


প্যান্ট্রিতে চলছে খাবার প্যাকিং-এর কাজ।

সত্যিই কী খাবার নিয়ে এই সমস্যার কথা জানে না রেল? এত শত অভিযোগের পরেও কেন সব কিছু এক রকম থেকে যায়? সব কিছু কি তাদের জানার বাইরে?

জবাবগুলো খুঁজে পাচ্ছেন না মুকেন্দ্রও। গত ২৫ জুন দিল্লির আনন্দবিহার থেকে হাওড়াগামী যুব এক্সপ্রেসে উঠেছিলেন তিনি। রাত আটটা নাগাদ ট্রেন ছাড়ার কথা। তাই রেলের ই-ক্যাটারিং পরিষেবায় রাতের খাবারটা মোবাইলের মাধ্যমেই অর্ডার করেন। কিছু ক্ষণ পর ফোন করে তাঁর অর্ডার নিশ্চিত করা হয়। এর পর খাবারও চলে আসে। মুকেন্দ্রকে দাম বাবদ ১৭৫ টাকা দিতে হয়। কিন্তু, সেই খাবার খেতে গিয়ে মুকেন্দ্র দেখেন গোটাটাই নষ্ট গিয়েছে। একটি দানাও তিনি দাঁতে কাটতে পারেননি। ফেলে দিতে হয়। এর পর তিনি ই-মেল করে রেলের অধীনস্থ সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়ে ক্যাটারিং অ্যান্ড ট্যুরিজম কর্পোরেশন’ (আইআরসিটিসি)-এর কাছে অভিযোগ জানান। গত ১৪ জুলাই তার জবাব পেয়ে মুকেন্দ্রর তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!

আইআরসিটিসি-র তরফে তাঁকে লেখা হয়েছে, ‘ভেন্ডর অপারগ হওয়ায় আপনার খাবার অনন্তবিহার স্টেশনে আমরা পৌঁছতে পারলাম না বলে দুঃখিত।’ অথচ খাবার তো এসেছিল! তা হলে রেল কেন বলল, খাবার দিতে পারলাম না? জবাব পাননি মুকেন্দ্র। বরং নাকের বদলে তিনি নরুণ পেয়েছেন। রেল তাঁকে ওই চিঠিতে একটি ‘ডিসকাউন্ট কুপন’ দিয়েছে। যার নম্বর উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, ওই ভাউচার ব্যবহার করে তিনি পরবর্তী কালে ১০০ টাকা ছাড় পাবেন রেলের খাবারে। বুধবার মুকেন্দ্র বলেন, ‘‘একে তো রাতে কোনও খাবার পেলাম না। উল্টে ১৭৫ টাকা গাঁটগচ্চা। এখন বলছে ১০০ টাকার ছাড় পাব। কী করব বলুন তো ওই কুপন নিয়ে!’’ ছাড় পেয়ে যে খাবার পরবর্তী সফরে কিনবেন, সেটাও যে ভাল হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়! আর রোজ রোজ তো কেউ দূরপাল্লার সফর করেন না। কাজেই মুকেন্দ্রর মতো যাত্রীদের রেলের উপর বিরক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে।

এ তো গেল ট্রেনের ভিতরের কথা। প্ল্যাটফর্ম বা স্টেশন চত্বরে কেমন খাবার পরিবেশন করে রেল? বেশি দূর যেতে হবে না। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন খড়্গপুর নিয়েই কী বলছেন যাত্রীরা শোনা যাক।

রেল মন্ত্রককে করা মেঘনার সেই টুইট:

দমদমের বাসিন্দা অনিলাভ বন্দ্যোপাধ্যায় রোজ কর্মসূত্রে খড়্গপুর যান। তিনি বলছিলেন, ‘‘খড়্গপুর স্টেশনে রেলের ভেন্ডররা যে চা বিক্রি করেন, তা কখনও খেয়ে দেখেছেন? গরম জল ছাড়া আর কিছু পাবেন না। বিস্বাদ। অথচ দাম পাঁচ টাকা। কেউ কেউ আবার সাত টাকাও নেন।’’ নিত্যযাত্রীরা মজা করে অনেকেই বলেন, সকালে ক্যানে যে ক’কাপ চা নিয়ে বেরোন চা বিক্রেতারা, সারা দিনের বিক্রি শেষে সেই একই পরিমাণ চা থাকে ক্যানে। তাঁদের দাবি, সারা দিন শুধু গরম জল মিশিয়ে চা বাড়ানো হয়! ফলে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চায়ের স্বাদ ফিকে হতে থাকে। প্ল্যাটফর্মে যে কচুরি, তরকারি, শুকনো আলুরদম, চপ বা ইডলি বিক্রি হয়, তার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। খোলা অবস্থায় ওই খাবার ট্রলিতে করে প্ল্যাটফর্মে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করা হয়। যা কোনও ভাবেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মাছি, ধুলো তো রয়েইছে, পাশাপাশি ওই খাবারে জীবাণূ-হানার আশঙ্কাও প্রবল সুনীল দাস নামে এক যাত্রী বললেন, ‘‘ওই আলুরদম যেমন ঝাল, তেমন অস্বাস্থ্যকর। খোলা পড়ে রয়েছে সব সময়। খেলে আর দেখতে হবে না! হাসপাতালে বেড বুক করে খাওয়া উচিত।’’ অথচ সেই খাবারই রোজ হাজার হাজার যাত্রী কিনে খাচ্ছেন। উপায় নেই।

কিন্তু, এ ভাবে খাবার বিক্রি করা যায়?

খোলা ভাবে খাবার বিক্রি করাটা নিয়ম বিরুদ্ধ বলে জানালেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ। পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘‘আমরা নিয়মিত নজরদারি চালাই। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। এমনিতে এ বছর রেল তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাচ্ছে। একটু তো সময় লাগবেই! ভেন্ডরদের প্রতি দিন সতর্ক করা হয়। রোজ রোজ তো আর রেলের পক্ষে চা টেস্ট করে দেখা সম্ভব নয়!’’

অথচ প্রতি দিন গোটা দেশে কয়েক লাখ যাত্রীর ভরসা এই রেলের খাবার। নিজেদের হাত থেকে সরিয়ে এ বছরের গোড়াতেই রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু খাবার বানানো থেকে পরিবেশন— সব কিছুর দায়িত্ব আইআরসিটিসি-র হাতে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু, লাভের লাভ হয়নি। শুধু খাবারের মান নয়, খাবারের পরিমাণ থেকে প্যান্ট্রি কর্মীদের ব্যবহার, এমনকী তার দাম নিয়েও বিস্তর অভিযোগ। সিএজি-র রিপোর্টেও সে সব কথা বলা হয়েছে। ওই রিপোর্টে যেমন বলা হয়েছিল, ট্রেন সফরে যে জল যাত্রীরা খান তা পানের অযোগ্য। অথচ সেই জলও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। খাবার স্বাস্থ্যবিধির ধার না ধারলেও, সেই খাবার বিক্রির সময়ে বাড়তি দাম নিতে পিছপা হচ্ছেন না প্যান্ট্রি কর্মীরা।


প্যান্ট্রিতে চলছে রান্না।

এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন মনোজ কুমার। হায়দরাবাদের বাসিন্দা এই মুহূর্তে মুম্বইতে রয়েছেন। এ দিন সেখান থেকে ফোনে বললেন, ‘‘এ মাসের প্রথম দিকে কোনার্ক এক্সপ্রেসে করে ফিরছিলাম। ৩৫ টাকার খাবার ১২০ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম জানেন। বিল চাইতে গেলে আমাকে শুধু মারতে বাকি রেখেছেন প্যান্ট্রি কর্মীরা। আর সেই খাবার যখন খেলাম, তখন তা পচে গিয়েছে।’’

উত্তরপ্রদেশের রেনুকুটের বাসিন্দা সুদীপকুমার ঝা-এর অভিজ্ঞতাটা আবার অন্য রকম। গত ১৪ জুলাই তিনি ঝাড়খণ্ড স্বর্ণ জয়ন্তী এক্সপ্রেসে করে আনন্দবিহার যাচ্ছিলেন। রাতের খাবারের অর্ডার দেন প্যান্ট্রিতে। ১১০ টাকা দিয়ে খাবার কেনার পর তিনি যখন রেটচার্ট এবং বিল চান, কথা না বাড়িয়ে তাঁর টাকা এবং খাবার— দুটোই নিয়ে চলে যান এক প্যান্ট্রি কর্মী। সুদীপ অভিযোগ জানিয়েছেন রেলকে। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘টাকাটা বোধহয় জলে গেল। রেলের জবাব পাইনি এখনও।’’

এত অভিযোগ যে জমা পড়ে, তা নিয়ে কী করে রেল?

সঞ্জয়বাবুর দাবি, অভিযোগ খতিয়ে দেখতে প্রত্যেক ডিভিশনেই আলাদা দফতর আছে। তারা গোটাটাই দেখে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দোষ প্রমাণিত হলে, জরিমানা, চুক্তি বাতিল-সহ নানা শাস্তির নিয়মও রয়েছে। নিয়ম মেনে উচ্চ পর্যায়ের কর্তাদের কাছেও ওই রিপোর্ট যায়। সঞ্জয়বাবু জানালেন, গত ছ’মাসে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কাছে সব মিলিয়ে ৩৩৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। তার মধ্যে খাবারের দাম বেশি চাওয়া হয়েছে বলে ২২১ টি অভিযোগ রয়েছে। খাবারের মান নিয়ে ৫২টি, খাবার পাওয়া যায়নি বলে ১৮টি, খাবার স্বাস্থ্যসম্মত নয় নিয়ে ৫টি, খাবারের পরিমাণ কম নিয়ে ৩টি, খারাপ ব্যবহারের জন্য ২টি অভিযোগ জমা পড়েছে। তাঁর দাবি, সব ক’টি অভিযোগই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এত কিছুর পরেও কী ভাবে ‘টিকটিকি-বিরিয়ানি’ জোটে যাত্রীদের? ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ছাড়া আর কোনও শব্দ খুঁজে পেলেন না রেলের ওই কর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rail Food Indian Railways IRCTC Poorva Express
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE