জলে বারবার ঢিল মেরে তরঙ্গ মাপতে চাইছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং সেই অভিঘাতকে কাজে লাগিয়ে নিজের সুবিধামাফিক বাণিজ্যচুক্তি সারতে চাইছেন— ট্রাম্পের ধারাবাহিক আক্রমণ বিশ্লেষণ করে এমনই জানাচ্ছে সাউথ ব্লক। কূটনৈতিক সূত্রের মতে, এমতাবস্থায় চটজলদি কোনও প্রতিক্রিয়া না দিয়ে, ট্রাম্পের ‘ফাঁদ’ এড়িয়ে দরকষাকষির মাধ্যমে বাণিজ্যচুক্তি সারতে চাইছে নয়াদিল্লি।
ভারতের অর্থনীতিকে গালমন্দ করা, ৩০ বার ভারত-পাক মধ্যস্থতার দাবি, ইসলামাবাদ-নয়াদিল্লিকে একই বন্ধনীতে রাখা, পাকিস্তানের থেকে ভারতকে তেল কেনার কথা বলে উত্তেজিত করার পিছনে এই নির্দিষ্ট নকশা রয়েছে বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা। বিদেশ মন্ত্রক জানাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে স্নায়ুর যুদ্ধে না হারা অগ্রাধিকার ভারতের।
বছরের শেষেই ভারতে ‘কোয়াড’ শীর্ষ সম্মেলন। এত কিছুর পরেও বিষয়টি নিয়ে ইতিবাচক বার্তাই দিচ্ছে বিদেশ মন্ত্রক। আজ মুখপাত্র রণধীর জায়সওয়ালকে ‘কোয়াড’ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “দু’দেশই আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোচ্ছে। ভারত এবং আমেরিকার সামগ্রিক আন্তর্জাতিক কৌশলগত অংশীদারি রয়েছে। যার ভিত্তি দু’দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নাগরিকদের মধ্যে জোরালো সংযোগ। এই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এর আগে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু আমরা আত্মবিশ্বাসী যে ভবিষ্যতে তা এগিয়ে চলবে।”
আমেরিকা বিশেষজ্ঞ তথা সে দেশে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত রণেন সেনের কথায়, “ট্রাম্প যে আচরণ করছেন তাতে কৌশলগত আস্থা তো কমারই কথা। কারণ, আমেরিকার এই প্রশাসন তো শুধু ভারত নয়, কোয়াডভুক্ত জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার উপরেও চাপ তৈরি করছে। ওয়াশিংটনের ভারতকে দরকার ছিল চিনের পাল্টা শক্তি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু ট্রাম্প চিনের সঙ্গে নিজেই সরাসরি চুক্তি করার পথে। সে ক্ষেত্রে ভারতের গুরুত্ব তাঁর কাছে কমতেও পারে।”
ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ভারতের কাছে কোয়াডের প্রাসঙ্গিকতা এখনও রয়েছে। যদিও ট্রাম্পের তুঘলকি কাণ্ডকারখানায় কোয়াডের প্রতি আমেরিকার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ভারতের এখন ধীরে সুস্থে অপেক্ষা করে সতর্ক নজর রাখা উচিত যে কোয়াডের স্বার্থের সঙ্গে তার স্বার্থ সংলগ্ন থাকছে কি না।’’
কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, ভারত এর আগে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করেছে। ১৯৯৮ সালে পোখরান পরমাণু পরীক্ষার পর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কবলে সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছয়। সেই পর্যায় থেকে আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক পরমাণু চুক্তি এবং কৌশলগত অংশীদারি করা সম্ভব হয়েছে। এখন তাই ধৈর্যের পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে ভারতের কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যকর্তাদের, যাঁরা আমেরিকার সঙ্গে দরকষকষির টেবিলে রয়েছেন। দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের রুজি কৃষিপণ্য এবং দুগ্ধজাত পণ্যের উপর সরাসরি নির্ভরশীল এবং ভারতীয় নেতারা সেখানে আমেরিকার সঙ্গে আপস করতে নারাজ বলে এখনও দাবি করা হচ্ছে। ট্রাম্প সমাজমাধ্যমের একের পর এক পোস্টে এমন স্নায়ুর চাপ তৈরি করতে চাইছেন যাতে আমেরিকার শর্ত মেনে নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করে ভারত। এ ক্ষেত্রে তাই সতর্ক থাকছে সাউথ ব্লক।
এই স্নায়ু টানটান পরিস্থিতিরমধ্যে আগামী ৫ তারিখ নয়াদিল্লি আসছেন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষ সচিব রিকি গিল। নয়াদিল্লির সঙ্গে তাঁর আলোচনা হওয়ার কথা ভারত-পশ্চিম এশিয়া-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে, যা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ দিনঝুলে রয়েছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)