রাত এগারোটা চল্লিশে ভাদোদারা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। চড়ে বসা তো নয়, বলা ভাল, ট্রেনে উঠেই শুয়ে পড়লাম। ভোর ছটায় ট্রেন থামল ভাদোদারা স্টেশনে। যেখানে থাকব ঠিক হয়েছিল সেই জায়গাটির ঠিকানা বলে উঠে পড়লাম অটোয়। দেখতে দেখতে চললাম চারপাশ। চওড়া রাস্তাঘাট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সবথেকে বড় যেটি চোখে পড়ল সেটি হল প্রকৃতি সংরক্ষণ। যেদিকে চোখ যায় সবুজের আলপনা শহর জুড়ে। হতে পারে হয়তো বর্ষাকাল বলে সবুজের আধিক্য। তবে আমাদের গন্তব্যে যখন পৌঁছে দিল অটো, তখন মনে হল এ কোথায় এলাম। এত সবুজ, এত সবুজ, এত সবুজ! কত রঙবেরঙের পাখি। আর কি আশ্চর্য একইসঙ্গে শুনতে পাচ্ছি কোকিল আর ময়ূরের ডাক। এ যে অদ্ভূত সমাপতন! বর্ষা আর বসন্ত একই সাথে! গেস্ট হাউসে মালপত্র রাখা আর একটু বিশ্রাম নেওয়ার অবসরে আসুন ভাদোদারা শহরটার বিবরণ দিয়ে দেওয়া যাক।
ভাদোদারা, যে শহরের পূর্ব পরিচিতি বরোদা হিসেবে, সেটি গুজরাতের তৃতীয় বৃহত্তম শহর আহমেদাবাদ এবং সুরাতের পরেই। এটি ভাদোদারা জেলার সদর শহর। এর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিশ্বামিত্রি নদী। রেলপথ এবং সড়কপথে ভাদোদারা যুক্ত হয়েছে দিল্লী এবং মুম্বইয়ের সাথে। ভারতের প্রথম দশটি উন্নয়নশীল শহরের মধ্যে বরোদা অন্যতম। বরোদার মহারাজা তৃতীয় সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের সময় থেকেই বরোদা শিল্পকলায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। বর্তমানে এটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, সংস্কৃতি এবং শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রস্থল। অনেক বড় বড় শিল্প যেমন – পেট্রোকেমিক্যাল, ইঞ্জিনীয়ারিং, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক প্রভৃতি রয়েছে এখানে। বরোদার প্রাথমিক ইতিহাস সম্বন্ধে জানা যায় যে এই অঞ্চলে ৮১২ খ্রীস্টাব্দে বণিক শ্রেণীর লোকেজন বসবাস করতে শুরু করে। সেই সময় অঞ্চলটি হিন্দু রাজাদের অধীন ছিল এবং ১২৯৭ সাল অবধি এই অঞ্চলে পর পর রাজত্ব করেছে গুপ্ত, চালুক্য এবং সোলাংকি রাজারা। তারপর দিল্লীতে সুলতানী আমল শুরু হয়, তখন শাসনভার চলে যায় সুলতানদের হাতে। এরপর দিল্লীতে মুঘল পর্ব শুরু হলে এই অঞ্চলের শাসন নিয়ে মুঘলদের বেগ পেতে হয় কারণ, সে সময় মারাঠারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও এই অঞ্চলের দখল নেয়। তৃতীয় সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের আমলে – যিনি ১৮৭৫ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন – তাঁর সময় শাসন সংক্রান্ত প্রভূত উন্নতি সাধিত হয় এখানে। বৃটীশের প্রতিপত্তি সত্ত্বেও বরোদা প্রিন্সলী স্টেট হিসেবে পরিগণিত হয় এবং স্বাধীনতার পর অন্যান্য প্রিন্সলী স্টেটের মত বরোদাও ১৯৪৭ এ ডোমিনিয়ন অফ ইণ্ডিয়া তে যোগ দেয়।
সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের কথা যখন উঠল, তখন আর একটা কথাও নাবলে পারছি না। বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড় একসময় ইংল্যাণ্ডে শিক্ষাগ্রহণ করতে যান এবং ইংল্যাণ্ডে পাঠরত কালীন তাঁর সঙ্গে শ্রী অরবিন্দ ঘোষের সাক্ষাৎ হয়। হ্যাঁ, বিপ্লবী শ্রী অরবিন্দ ঘোষ - মাত্র সাত বছর বয়সেই তাঁর পিতা ডাক্তার কৃষ্ণধন ঘোষের সঙ্গে তিনি ইংল্যাণ্ড পাড়ি দেন এবং তাঁর ছাত্রজীবন ইংল্যাণ্ডেই অতিবাহিত হয়। পিতা কৃষ্ণধন শ্রী অরবিন্দকে পাকা সাহেব তৈরি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিধাতার কি অভিপ্রায়! শ্রী অরবিন্দ হয়ে উঠলেন খাঁটি দেশপ্রমিক, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও। ইংল্যাণ্ডে বরোদার মহারাজার সঙ্গে শ্রী অরবিন্দের আলাপ ক্রমশঃ গভীর সখ্যতায় পরিণত হল। অরবিন্দ বরোদার মহারাজা সয়াজীরাও গায়কোয়াড়ের শিক্ষক ও প্রাইভেট সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন। ১৮৯৩ সালে বরোদার মহারাজার সঙ্গে একত্রে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন। চোদ্দো বছর পর দেশে ফিরে তিনি বরোদাতেই রইলেন, তখনও তিনি গায়কোয়াড়ের প্রাইভেট সেক্রেটারি। এই বরোদাতেই সিস্টার নিবেদিতার সংস্পর্শে আসেন শ্রী অরবিন্দ। তাঁদের সাক্ষাৎকার ভারতীয় বিপ্লবের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বরোদার মহারাজার সংগে শ্রী অরবিন্দের ঘনিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে আমাদের বঙ্গসন্তানদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সমৃদ্ধ ঘটনা।
বরোদা অর্থাৎ অধুনা ভাদোদারাও যে বাংলা ও বাঙালির কৃষ্টির কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠবে এতে আর সন্দেহের অবকাশ কোথায়! ইতিহাসের পাতা থেকে এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক বরোদার বর্তমান বাঙালি সমাজের দিকে। বরোদার জীবনযাত্রা মুম্বইয়ের মত এমন দ্রুত ধাবমান নয়।