Advertisement
E-Paper

দুর্গাপুজোই উৎস মধ্যশহর সমিতির

১৯৪৭ সাল। দেশভাগের ফলে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে শিলচরে আসেন হাজার হাজার মানুষ। কোথায় থাকবেন তাঁরা! স্কুলগুলিতে অনির্দিষ্টকালের ছুটি ঘোষণা হয়। সমস্ত ছাত্রাবাসের সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উদ্বাস্তুরা প্রথমে সে সবেই মাথা গোঁজে। কিন্তু কী খাবেন!

প্রশান্তকুমার বসু

শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:৩১

১৯৪৭ সাল। দেশভাগের ফলে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে শিলচরে আসেন হাজার হাজার মানুষ। কোথায় থাকবেন তাঁরা! স্কুলগুলিতে অনির্দিষ্টকালের ছুটি ঘোষণা হয়। সমস্ত ছাত্রাবাসের সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উদ্বাস্তুরা প্রথমে সে সবেই মাথা গোঁজে। কিন্তু কী খাবেন! কী পরবেন! সরকারি-বেসরকারি স্তরে ত্রাণের ব্যবস্থা হলেও শহরে বেড়ে যায় চুরি, ছিনতাই, লোক ঠকানো। পুলিশ বিভাগ সে সব ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ। পাড়ায় পাড়ায় যুবকরা পাহারা দিতে শুরু করেন। শহরের মধ্য অঞ্চল অর্থাৎ গাঁধীবাগ, নরসিংটোলা, শিলংপট্টি, সেন্ট্রাল রোড, তুলাপট্টি, উকিলপট্টি, জানিগঞ্জএলাকার যুবা-দলও নৈশ প্রহরায় নিয়োজিত হন।

ধীরে ধীরে এক দিন পরিবেশ স্বাভাবিক হলে পাহারা ব্যবস্থা উঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে পাহারার নামে এত দিনের জোটবন্ধনকে ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা। প্রথমে দুর্গাপূজা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। (প্রয়াত) রামদয়াল লালাকে সম্পাদক করে তৈরি হয় মধ্যশহর দুর্গাপূজা কমিটি। নরসিংটোলা পুকুরের পূর্বপারে মণীন্দ্রচন্দ্র দাসের বাড়ির সামনে সর্বজনীন পূজা হয়। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেন তাঁরা। সে সূত্রেই জন্ম নেয় মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতি। সে থেকে আজও পুকুরপারে নিয়মিত দুর্গাপূজা হচ্ছে। কিছু দিন পরই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

ষাটের দশকে শিলচরে জেলা ক্রীড়া সংস্থা যাত্রা শুরু করে। সমিতির সদস্যরা তাতে যুক্ত হলেন। সেই সূত্রে ক্রীড়াক্ষেত্রেও জড়িয়ে পড়েন সকলে। পাশাপাশি শুরু হয় বিভিন্ন রকমের সামাজিক কাজকর্ম। ধীরে ধীরে কর্মীর ঢল নামে সমিতিতে। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা তখন। বিভিন্ন বিভাগে যোগ্য ব্যক্তিদেরই নেতৃত্বে পাওয়া যায়। নাটক নির্বাচনে এগিয়ে আসতেন প্রয়াত মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য ও প্রয়াত কলিনন্দন কর্মকার। মুকুন্দবাবু পরিচালনায় থাকতেন। মঞ্চ পরিকল্পনায় প্রয়াত সুধীরমোহন ব্যানার্জি। আলো পরিকল্পনায় প্রয়াত কেশবলাল ভট্টাচার্য। আলোর ব্যবহারে প্রয়াত নবেন্দু সাহা। শব্দের পরিকল্পনা ও প্রয়োগে প্রয়াত অনন্ত ভট্টাচার্য। সুনীল পাল, মণি কুণ্ডু, রবি সাহা, গোপাল গোস্বামী, রজত ভট্টাচার্য— আরও কত নাম যে বলতে হয়! শিল্পীদের নাম উল্লেখ করলে সে সুদীর্ঘ তালিকা। তবু পরাণ চক্রবর্তী, নিলু সেন, সাধন কর্মকার, দিলু ধর, কুনু সাহা-র নাম উল্লেখ করতেই হয়।

বিভিন্ন সময়ে ক্লাবের পক্ষ থেকে নাটক প্রতিযোগিতা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হতো। জেলার বন্যার্তদের সাহায্যেও অনেক নাটক প্রতিযোগিতা হয়েছে। সে সময় প্রতি বছর এই অঞ্চলে ছোট-বড় বন্যা হতো। বন্যার কবলে পড়ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদীর বন্যা একবার বিধ্বংসী চেহারা নিলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। সে সময় অর্থ ও জামাকাপড় সংগ্রহ করে পাঠানো হতো। ১৯৬১ সালের ভাষা আন্দোলনে সমিতি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ভাবে আন্দোলনকারীদের সহায়তা করে।

চরাইয়ের পর যেমন উৎরাই থাকে, তেমনি সমিতির ‘সূর্য’ সব সময় মধ্যগগনে থাকেনি। সত্তরের দশকের পর সঙ্কটের শুরু। উদ্যমীদের অনেকে চিরতরে বিদায় নেন। কেউ কেউ কাজের সন্ধানে বাইরে পাড়ি জমান। সমিতির কাজে ভাটার টান স্পষ্ট ধরা পড়ছিল। নাটক মঞ্চস্থ করা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শুধু সাধারণ সভা আর কমিটি পুনর্গঠন চলছিল।

কয়েক বছর থেকে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন দুর্গোৎসবে জৌলুস বেড়েছে। সাংস্কৃতিক সমারোহও বেশ বড় আকারে হয়। তবু যেন সেই সোনালি দিনগুলির খোঁজ মেলে না। সবই হয়, এর পরও কেন যেন মনে হয়, পুরনো দিনের আন্তরিকতা নেই। সপ্তাহব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজেদের বাড়িঘরের ছেলেমেয়ে ক’জন আর অংশ নেয়! এ অবশ্য অস্বীকার করা যায় না, শিলচর শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিল্পীদের এনে অনুষ্ঠান করানোর দরুন দর্শক-শ্রোতাদের আগ্রহ বাড়ছে।

পাশাপাশি জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রতিযোগিতায় নিয়মিত যোগদান করলেও মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতি নিজেরা লাগাতার ভাবে কোনও খেলাধূলার ব্যবস্থা করতে পারছে না। এ জন্য মাঠের সংকীর্ণ পরিসরও কম দায়ী নয়। এ দিকে, শহরের একমাত্র পুকুর গত ৪০ বছর ধরে সমিতির পক্ষ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। পুকুরের চারপাশে পাচিল তোলা হলেও শহরবাসীর ঔদাসীন্যে তার চতুর্দিকে পুতিগন্ধময় পরিবেশ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কাজে পুকুরটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে, কিন্তু একে ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব কেউ নিতে রাজি নয়। এক সময় নাটকের রিহার্সালের জায়গা মিলত না। এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে রিহার্সাল হতো। এখন সেই সমস্যা নেই। জেলার বহু লোকের সাহায্য, সহানুভূতি ও আন্তরিকতায় আজ সমিতির নিজস্ব ক্লাবঘর তৈরি হয়েছে। শহরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এর সুবিধা নিতে পারছে। আশা করা যায়, নিজেদের একটা পাকা ঠিকানা পেয়ে যুবসমাজ বেশি করে ক্লাবের কাজকর্মে আকৃষ্ট হবে।

কবির ভাষায় হলা যায়—
‘নব দিনমান উদিবে আবার/পুরাতন এ পুরবে।’

Durga Puja Madhyashar Cultural Association
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy