Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বাবার বিরুদ্ধে মামলায় রাশ সব সরকারের

এই সময়ে নিরাপত্তা চেয়ে লিখিত আবেদন করেছিলেন ‘পুরা সচ্’ পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতি। চৌটালা সরকারের পুলিশ তাঁকেও নিরাপত্তা তো দেয়ইনি, উল্টে তাঁর খুনের মামলাটি ভেস্তে দেওয়ার সব রকম চেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ।

সুব্রত বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৭ ০৪:১১
Share: Save:

সরকার আসে, সরকার যায়। ‘বাবা হজুরের’ সাম্রাজ্য বাড়তেই থাকে।

লাগাম টানা দূরের কথা, এত দিন তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ারই চেষ্টা করেছে সবাই। শুধু বিজেপির মনোহরলাল খট্টরের বিরুদ্ধেই নয়, লোকদলের ওমপ্রকাশ চৌটালা থেকে কংগ্রেসের ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা—সব মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই একই অভিযোগ তুলেছেন সিরসার বাসিন্দাদের একাংশ।

২০০২ সালে ডেরা সচ্চা সৌদার এক সাধ্বীর চিঠি পেয়েই ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’ গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল পঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্ট। হাইকোর্ট মনে করেছিল, মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমলারা যার কাছে নতজানু, তাদের পুলিশ এই তদন্ত নিরপেক্ষ ভাবে করবে না। সেই সময় হরিয়ানায় ক্ষমতায় ছিলেন লোকদলের ওমপ্রকাশ চৌটালা। হাইকোর্ট ভরসা রাখতে পারেনি তাঁর পুলি‌শের উপরে। কারণ, ওই চিঠি স্থানীয় পত্রিকা ‘পুরা সচ্’-এ প্রকাশিত হওয়ার পরেই খুন হয়ে যান ওই সাধ্বীর ভাই, ডেরার প্রাক্তন সাধু র়ঞ্জিত। হরিয়ানা পুলিশ তাঁকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি।

এই সময়ে নিরাপত্তা চেয়ে লিখিত আবেদন করেছিলেন ‘পুরা সচ্’ পত্রিকার সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতি। চৌটালা সরকারের পুলিশ তাঁকেও নিরাপত্তা তো দেয়ইনি, উল্টে তাঁর খুনের মামলাটি ভেস্তে দেওয়ার সব রকম চেষ্টা চালিয়েছে বলে অভিযোগ।

সচ্চা-কাহন

• এপ্রিল, ২০০২: তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর কাছে বেনামি চিঠিতে ডেরা-প্রধান গুরমিত রাম রহিমের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এক সাধ্বীর।

• মে, ২০০২: সিরসা জেলা ও দায়রা বিচারককে তদন্তের নির্দেশ পঞ্জাব ও হরিয়ানার হাইকোর্টের।

• সেপ্টেম্বর, ২০০২: জেলা আদালত যৌন হেনস্থার সম্ভাবনার কথা জানায়। হাইকোর্ট মামলার ভার দেয় সিবিআইয়ের হাতে।

• ডিসেম্বর, ২০০২: ডেরা-প্রধানের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হুমকি, শ্লীলতাহানির মামলা দায়ের করল সিবিআই।

• ২০০৫-২০০৬: সিবিআই কর্তা সতীশ দগর পুনরায় তদন্ত শুরু করেন। খোঁজ শুরু হয় নির্যাতিতাদের।

• জুলাই, ২০০৭: ডেরা-প্রধানের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের চার্জশিট পেশ অম্বালা আদালতে। তাতে দুই সাধ্বী-র যৌন হেনস্থার উল্লেখ।

• সেপ্টেম্বর, ২০০৮: সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে গুরমিতের বিরুদ্ধে ৩৭৬ (ধর্ষণ) ও ৫০৬ (ভয় দেখানো) ধারায় চার্জ গঠন।

• ২০০৯-২০১০: আদালতের কাছে দুই নির্যাতিতার বয়ান রেকর্ড।

• এপ্রিল, ২০১১: বিশেষ সিবিআই আদালত ও ডেরা-প্রধানের মামলাটি অম্বালা থেকে পঞ্চকুলায় স্থানান্তরিত।

• ২০১৬: আদালতে সমন ৫২ জন সাক্ষীকে।

• জুন, ২০১৭: দেশ ছেড়ে যাওয়া যাবে না, নির্দেশ ডেরা-প্রধানকে।

• ১৭ অগস্ট, ২০১৭: পক্ষে-বিপক্ষে সওয়াল-জবাব। ২৫ অগস্ট রায় ঘোষণার দিন ধার্য। ডেরা-প্রধানকে সে দিন আদালতে হাজিরার নির্দেশ।

• ২৫ অগস্ট, ২০১৭: বিশেষ সিবিআই আদালতে দোষী সাব্যস্ত ডেরা-প্রধান। নেওয়া হল বিচার-বিভাগীয় হেফাজতে। রায়ের বিরুদ্ধে ডেরা-অনুগামীদের তাণ্ডব, মৃত ৩৭। রোহতকের জেলে রাম রহিম।

• ২৮ অগস্ট, ২০১৭: রাম রহিমের মোট ২০ বছরের কারাদণ্ড।

এখনও বাকি

• সেপ্টেম্বরে ‘পুরা সচ্‌’-এর সম্পাদক রামচন্দ্র ছত্রপতি ও ডেরা সচ্চা সৌদার ম্যানেজার রঞ্জিত সিংহ খুনের মামলার রায় ঘোষণার সম্ভাবনা

কী ভাবে? সিরসার আইনজীবী লেখরাজ ঢোট সোমবার জানান, পাঁচ-পাঁচটা গুলি শরীরে নিয়ে দিল্লির একটি হাসপাতালে তখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন রামচন্দ্র। বারবার আর্জি পেশ করার পরে এক তদন্তকারী অফিসার তাঁর জবানবন্দি রেকর্ডের জন্য হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে রামচন্দ্র জানান, তাঁকে যারা গুলি করেছিল তারা সবাই রাম রহিমের লোক।

এই জবানবন্দি (সিআরপিসি ১৬১) যখন রেকর্ড করা হয়, তখন রামচন্দ্রের পাশে ছিলেন তাঁর বড় ছেলে অংশুল ও দুই আত্মীয়। কিন্তু পরে দেখা যায়, ওই জবানবন্দি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘বাবা হজুরে’র নামই! লেখরাজ বলেন, ‘‘আমরা বারবার বলার পরেও পুলিশ জবানবন্দি নেওয়ার সময়ে সিআরপিসি ১৬৪ ধারা মোতাবেক কোনও ম্যাজিস্ট্রেট রাখেনি। এই খুনের মামলা থেকে বাবা হজুরকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ ও এলাকার রাজনৈতিক নেতারা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।’’ অংশুলও সোমবার আনন্দবাজারকে ফোনে বলেন, ‘‘জবানবন্দি থেকে গুরমিত রাম রহিমের নাম বাদ যাওয়ায় আমরা কার্যত ভেঙে পড়েছিলাম। পরে সবাই মিলে ঠিক করি, হরিয়ানা পুলিশের উপরে আর ভরসা রাখা যাবে‌ না। হাইকোর্টে গিয়ে সিবিআই তদন্ত চাইতে হবে।’’

২০০৪ সালে হরিয়ানায় ক্ষমতায় আসেন কংগ্রেসের ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা। তাঁর সরকারের আমলেও বাড়বাড়ন্ত চলতেই থাকে বাবা রাম রহিমের। হুডা সরকার তাকে জেড প্লাস নিরাপত্তা পাইয়ে দেয়। আইনজীবীদের অভিযোগ, রাম রহিমের বিরুদ্ধে আনা সাধুদের লিঙ্গচ্ছেদের মামলাটিও কার্যত ধামাচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করে রাজ্য পুলিশ। এই মামলাটি এখনও রাজ্য পুলিশের হাতেই রয়েছে। হুডার পরে ক্ষমতায় আসে বিজেপির খট্টর সরকার। এর মধ্যে রাম রহিম বিজেপির হয়ে ভোট প্রচারে নেমে পড়ে। হাইকোর্টেরই কথায়, রাম রহিমের কাছে ‘রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ’ করেছে খট্টর সরকার।

‘বাবা হজুরে’র কাছে তাই লোকদল, কংগ্রেস, বিজেপি— সবাই সমান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE