Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আমাদের সবার রক্তের মধ্যে কাঁটাতার আছে

রাজকাহিনী’ এবং ‘বেগমজান’ তৈরি করার আগে আর পরে ‘সীমান্ত’ বিষয়টা নিয়ে আমার ধারণার একটা বিবর্তন ঘটেছে। ছবি দুটো তৈরির আগে নানান জনপ্রিয় নভেল পড়েছি, সিনেমা দেখেছি।

সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘রাজকাহিনী’ ছবির দৃশ্য

সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘রাজকাহিনী’ ছবির দৃশ্য

সৃজিত মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০৩:০২
Share: Save:

রাজকাহিনী’ এবং ‘বেগমজান’ তৈরি করার আগে আর পরে ‘সীমান্ত’ বিষয়টা নিয়ে আমার ধারণার একটা বিবর্তন ঘটেছে। ছবি দুটো তৈরির আগে নানান জনপ্রিয় নভেল পড়েছি, সিনেমা দেখেছি। অনেক কিছু পড়েছি এই বর্ডার বিষয়টা নিয়ে। আমাদের বাঙালিদের তো সীমান্ত বলতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কথাই মনে আসে। মনে গেঁথে থাকা অনেক ইমেজ, দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। সেগুলো মোটের ওপর সে রকমই, যেমনটা আমরা ইতিহাসের পাতায় বা উপন্যাসে পড়েছি, কিংবা দেখেছি ‘গরম হাওয়া’, ‘তমস’ বা ‘পিঞ্জর’-এ। এই ইমেজ যে সব সময় কাঁটাতারের ইমেজ, তা নয়। মানুষের ওপর কাঁটাতারের যে ইমপ্যাক্ট, সে সংক্রান্ত ইমেজও। এই সব দেখে, পড়ে, মাথার মধ্যে একটা কোলাজ ছিল।

ছবি দুটো করার পর, ‘সীমান্ত’ ব্যাপারটা চেতনার অনেক, অনেক গভীরে চলে গেছে। এই যে আমাদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসটাকে, আমাদের এই উপমহাদেশটাকে একেবারে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া লাইন দুটো, সে দুটো এত দায়সারা ভাবে, হালকা ভাবে, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে টানা, এই পুরো ব্যাপারটার অ্যাবসার্ডিটি আমাকে আশ্চর্য করে দেয়। যন্ত্রণার বোধ তো আছেই, কিন্তু তারও আগে মনে হয়, এটা হল কী করে? এই যে একটা রাজনৈতিক কাঁটাতার টানা, সেটা মানুষ মেনে নিলেন? কী ভাবে? এর জন্য যে দামটা চোকাতে হবে, সে ব্যাপারে কি তাঁরা আদৌ কিছু জানতেন? ভেবেছিলেন এই নিয়ে?

এই সূত্রেই অনেক পড়াশোনা করেছিলাম। ‘রাজকাহিনী’ করার আগে জয়া চট্টোপাধ্যায়, মুরশিদুল হাসান, ঊর্বশী বুটালিয়া, হৈমন্তী রায়, এঁদের অনেক বই, লেখা পড়তে হয়েছিল। সীমান্ত, কাঁটাতার, এই সংক্রান্ত এত এত তথ্য সেখানে জানতে পেরেছিলাম, কী বলব! একটা জায়গা মনে পড়ছে। র‌্যাডক্লিফ সাহেব তখনও লাইনটা টানেননি। সেটা কোন কোন জায়গা দিয়ে, কী ভাবে যাবে, এই নিয়ে আলোচনা চলছে। তখন নানান সংস্থা, সমিতি, এমনকী রাজনৈতিক দলগুলোও এই সীমান্তরেখা নিয়ে তাদের প্রোপোজাল কোর্টে জমা দিচ্ছিল। প্রত্যেকেই এক-একটা ম্যাপ নিয়ে এসে বলছেন, উপমহাদেশের ম্যাপ এই হওয়া উচিত, ওই হওয়া উচিত। হিন্দু মহাসভা এক রকম ম্যাপ এনে হাজির করছে, মুসলিম লিগ আর এক রকম। কংগ্রেসেরই দু’রকম ম্যাপ প্রোপোজ করা হয়েছিল। কেউই ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয়। এই রকম একটা ভৌগোলিক টানাপড়েনের মাধ্যমে আমাদের অদৃষ্ট নির্ধারণ হয় ১৯৪৭-এ।

এই প্রত্যেকটা প্রোপোজালই আমাকে পড়তে হয়েছে। তখন বুঝতে পেরেছি, এগুলো সব এক-একটা উল্লেখযোগ্য দলিল— এটা বোঝার, যে, জিনিসটা কাটাছেঁড়ার কোন পর্যায়ে গিয়েছিল তখন। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে আমরা কথা বলছি বিরাট একটা দেশ ভাগ করা নিয়ে। অগণিত মানুষের, অনেকগুলো ধর্মের, কৃষ্টির, একটা বিশাল সভ্যতার ইতিহাসকে ভাগ করা নিয়ে। আর এই বিশাল বিষয়টাই নেমেছিল— ঠিক যেমন ছোট্ট এক খণ্ড জমি নিয়ে দুই প্রতিপক্ষ খুব দৃষ্টিকটু রুচিহীন ঝগড়া করে— সেই রকম নিচু স্তরে। পুরো ব্যাপারটাকে কেবল একটা রাজনৈতিক চাহিদার মোড়ক দেওয়া হয়েছিল, এই যা তফাত।

কাঁটাতার, সীমান্ত তো টানা হল। তার ফলে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, সেই দাঙ্গার যে বিবরণ, যে গল্প, সেও ভয়ংকর। তার কিছু খণ্ডচিত্র আমরা পেয়েছি সাদাত হাসান মান্টোর লেখায়। মান্টো আমাকে খুবই উদ্বুদ্ধ করেছেন ‘রাজকাহিনী’ বানাতে। এই ছবির ওপেনিং সিকোয়েন্সটাই তো ওঁর লেখা গল্প থেকে নেওয়া, ওঁর প্রতি আমার ট্রিবিউট। আমার মনে হয়েছিল, আমিও ছবিতে কথা বলব এই সব ‘অ্যাকচুয়াল’ মানুষদের নিয়ে। সেই সব ‘ফ্যাক্ট’ নিয়ে, যা ফিকশন নয়। কল্পনা নয়। সেই সময়কার অনেক মানুষ চিঠি লিখেছিলেন একে অন্যকে। ঊর্বশী বুটালিয়ার বইয়ে সেই সব চিঠির রেফারেন্স পেয়েছি। পড়েছি। ‘Towards Freedom’ নামে একটা খুব ভাল বই পড়েছি (ওটার অনেকগুলো খণ্ড। সুচেতা মহাজন আর সব্যসাচী ভট্টাচার্য সম্পাদিত, ১৯৪৭ সংক্রান্ত দুটো খণ্ড পড়েছি), সেখানেও অনেক চিঠি, তথ্য, সেই সময়কার কাগজের কাটিং, দলিল, আর্টিক্‌ল, কাগজকে লেখা নানা মানুষের চিঠি— পেয়েছি। এই জ্বলন্ত সময়ের দলিলগুলো পড়তে পড়তে অদ্ভুত একটা ছবি উঠে এসেছিল চোখের সামনে।

এই ছবিটাকেই যখন ‘ছবি’, মানে সিনেমা বানিয়ে তুলতে শুটিং শুরু করলাম, সে আর এক অভিজ্ঞতা। একটা জমিতে শুটিংয়ের জন্য যখন একটা নকল কাঁটাতার লাগাচ্ছি, আর আমার জুনিয়র আর্টিস্টরা যখন রিফিউজি সেজে সেই কাঁটাতারের এ-পার ও-পার করছেন, কোথাও যেন সত্যিই নিজেকে জাতিস্মরের মতো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, বহু বছর আগে নিশ্চয়ই এ ভাবে আমার আগের আগের, বা তারও আগের প্রজন্মের মানুষরা কাঁটাতার পেরিয়ে, নিজেদের বাড়িঘরদোর হারিয়ে, ‘ঘর’ বা ‘দেশ’-এর সংজ্ঞাটা যে ঠিক কী, সেটা খুঁজতে খুঁজতে এই দেশে এসেছিলেন। বা, নিজের দেশের মধ্যেই, এক জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় গিয়েছিলেন। আর এ সব কিছুই, একটা কৃত্রিম, রাজনৈতিক লাইন টানার ফল হিসেবে। শুটিংয়ের সময় এই ভাবনাগুলো আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।

‘রাজকাহিনী’ লেখার সময় আমি অনেকটাই ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। এই দেশভাগ, সীমান্ত, দাঙ্গা, এ-সব নিয়েই রোজ থাকতে হত কিনা! বাস্তুহারাদের বয়ান, তাঁদের জীবন, যন্ত্রণার মধ্যে বাস করতে হয়েছে আমাকেও। শুটিং করতে এমনিতে খুব শারীরিক কষ্ট, ধকল হয়েছিল। কিন্তু সেটা আমার, আমাদের কারও গায়ে লাগেনি। মনে হয়েছিল, আমরা ইতিহাসকে রিক্রিয়েট করছি। আমাদের সবার রক্তের মধ্যে, শেকড়ের মধ্যে এই ইতিহাসটা আছে। কাঁটাতারটাও।

‘বেগমজান’ করার অভিজ্ঞতাটা আবার অন্য রকম। এখানে প্রেক্ষাপটটা পালটে আমরা পঞ্জাবে নিয়ে গিয়েছি। তাই আবার নতুন করে পড়াশোনা করতে হয়েছে। এই সীমান্তের প্রসঙ্গেই একটা খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস মনে হয়েছে, বাংলার পার্টিশন আর পঞ্জাবের পার্টিশনের মধ্যে কিন্তু অনেক তফাত। বাংলারটার বেলায় তবু অনেক আলোচনা তর্কাতর্কি হয়েছিল, পঞ্জাবেরটা যেন দুম করে সেরে দেওয়া হল। ওই এক কোপেই লক্ষ লক্ষ মানুষ একটা সীমাম্তের এ-পারে বা ও-পারে নিজেদের আবিষ্কার করলেন। এটা মাথায় রাখতে হবে। পড়াশোনা করে এটা বুঝতে পারলাম। বাংলার ক্ষেত্রে যেমন, আজ এখানে একটা ঘটনা ঘটল, কাল ওখানে, আজ এই দিক দিয়ে কিছু মানুষ পারাপার করলেন, আবার ওই দিক দিয়ে কিছু ও-দিকে গেলেন, এ রকম। ‘অ্যাট আ টাইম’ নয়।

অনেক দিন-মাস-বছর ধরে, নানান ভাবে, একটু একটু করে চুঁইয়ে যেন ঘটেছিল ব্যাপারটা। কিন্তু দেশভাগ বলতেই যে ব্যাপারটা মনে আসে, তা ঘটেছিল পঞ্জাবের ক্ষেত্রে। লাইন দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক পার হচ্ছে (রিচার্ট অ্যাটেনবরো-র ‘গাঁধী’ ছবিতে যেমন অসাধারণ ভিস্যুয়াল দেখি)। আমাকে পরে অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, কেন ‘বেগমজান’-এর ক্ষেত্রে আমি প্রেক্ষাপটটা পালটালাম। আমার একটাই উত্তর। যন্ত্রণার তো কোনও প্রদেশ, কোনও সীমান্ত হয় না। এটা আমার কাছে নতুন একটা ‘milieu’। একটা নতুন প্রদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছি। একটা সম্পূর্ণ নতুন যাত্রা। এই জার্নিটার লোভেই কিন্তু ‘বেগমজান’ করছি। একটা নতুন কাঁটাতারের গল্প বলতে পারব বলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

srijit mukhopadhyay independence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE