আগুন আর কালো ধোঁয়ার চাদর তখন মুড়ে ফেলেছে অতিকায় বাড়িটার ওপরের তলাগুলোকে। সে দিকে তাকিয়ে মাঝবয়সি ভদ্রলোক বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘বহু বছর ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা হয়েছিল জায়গাটাকে। আজকের পরে আর কিছুই হয়তো থাকবে না।’’
কিছু আদৌ আছে কি না, এখনও নিশ্চিত খবর নেই। কারণ, গত কাল গভীর রাতের বিধ্বংসী আগুনে পুড়ে যাওয়া নয়াদিল্লির ‘ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’র বাড়িটায় এ দিন ঢুকতেই দেওয়া হয়নি সংবাদমাধ্যমকে। কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, একেই পুরনো বাড়ি। তার পর আগুনে পুড়ে সেটি আরও বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে আরও একটি দুর্ঘটনা।
ফলে জানা যাচ্ছে না, ঠিক কী অবস্থায় আছে আটত্রিশ বছরের সংগ্রহ। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে সিংহ, হায়না, একশৃঙ্গ গন্ডার-সহ নানা ধরনের পশু-পাখির ‘স্টাফ’ করা মৃতদেহ নিয়ে প্রায় হাজারেরও বেশি নমুনা রাখা ছিল এই সংগ্রহশালায়। পৃথিবীতে কী ভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে, তা নিয়ে ছিল একটি প্রদর্শনীও। গত রাতের ঘটনার পর কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের আশঙ্কা, সে সবই হয়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রথমে আগুনে, তার পর জলে। সেই কথাই বলছিলেন মাঝবয়সি ওই প্রত্যক্ষদর্শী।
তবে সব চেয়ে বেশি চিন্তা যেটিকে নিয়ে, সেটি হল— ফসিল হয়ে যাওয়া একটি ডাইনোসরের হাড়! প্রায় ১৬ কোটি বছর আগেকার অর্থাৎ জুরাসিক যুগের এই ডাইনোসরটির জীবাশ্মের সন্ধান মিলেছিল ভারতেই। অন্ধ্র-মহারাষ্ট্র সীমানার প্রাণহিতা-গোদাবরী বেসিন অঞ্চলে এটির খোঁজ পেয়েছিল ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-এর পুরাজীববিদ্যার দল। ‘সৌরপদ’ শ্রেণির এই ডাইনোসরের জীবাশ্মটিকে পূর্ণাঙ্গ চেহারা দিয়ে রাখা আছে কলকাতার আইএসআই-তে। তবে তার একটি হাড় দিল্লির সংগ্রহশালাকে উপহার দিয়েছিলেন আইএসআই কর্তৃপক্ষ।
কলকাতার এই ডাইনোসরের নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ। জীবাশ্মটি আবিষ্কৃত হয় রবীন্দ্র-শতবর্ষের বছর, ১৯৬১ সালে। আইএসআই তাই এই বিশেষ ডাইনোসরটির নামকরণ করেছিল কবিগুরুর পদবি-সহযোগে— ‘বড়াপাসরাস টেগোরাই’। ‘বড়াপা’— অর্থাৎ বড় পা। আইএসআই-এর ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শাশ্বতী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ডাইনোসরটির পায়ের একটি ‘ফিমার’ হাড়ের ফসিল উপহার দেওয়া হয়েছিল দিল্লিকে। এখন সেটি তাদের সম্পত্তি।’’ কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের পরে সেটি কী অবস্থায় আছে, তা নিয়ে ঘোর চিন্তায় কেন্দ্র।
কী করে আগুন লাগল, জানা যায়নি। যে বহুতলে সংগ্রহশালা, লিজে সেটির মালিকানা বণিকসভা ‘ফিকি’র। গত কাল রাত দেড়টা নাগাদ আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে গোটা দশেক দমকলের ইঞ্জিন ঘটনাস্থলে যায়। কিন্তু জলের অভাবে সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। তখন সংলগ্ন মান্ডি হাউস মেট্রো স্টেশন থেকে রিলে করে জল আনা হতে থাকে। সূত্রের দাবি, আগুন প্রথমে লাগে উপরের তলায়। গত কয়েক দিন ধরে সেখানে মেরামতির কাজ চলছিল। পরে আগুন নীচের চারটি তলায় ছড়িয়ে পড়ে। দমকলের সহ-অধিকর্তা রাজেশ পানওয়ার বলেন, ‘‘কাঠের শো-কেস, তাতে রাখা বিভিন্ন প্রাণিদেহের নমুনা এবং ওই দেহ সংরক্ষণে ব্যবহৃত দাহ্য রাসায়নিকের জন্যই দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে।’’ চার ঘণ্টারও বেশি সময়ের চেষ্টায় ৩৫টিরও বেশি ইঞ্জিন আগুন আয়ত্তে আনে। কোনও মৃত্যুর খবর নেই। তবে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়েছেন ছ’জন দমকলকর্মী।
অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থায় ত্রুটির অভিযোগ মানতে চাননি ফিকি কর্তারা। তবে সংগ্রহশালাটির দুর্দশা নিয়ে সম্প্রতি একটি রিপোর্ট দিয়েছিল সংসদীয় কমিটি। ভবনটির ভেঙে-পড়া দশা, শো-কেস ও নমুনাগুলির জীর্ণ অবস্থা, খারাপ অডিও-ভিডিও নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তারা। তার পরেই ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দিল্লির পুরানা কিল্লার পিছনে সাড়ে ছ’একর জমিতে নতুন একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্র। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নতুন ভবনের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তার আগেই এই ঘটনা।
আজ কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর বলেছেন, ‘‘আগুনে হাজার-হাজার নমুনা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যেই যতটা সম্ভব উদ্ধার করার চেষ্টা চলছে।’’ তিনি জানান, মন্ত্রকের অধীনে যে ৩৪টি মিউজিয়াম রয়েছে, সেগুলির আগুন নেভানোর ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy