Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

খাপলাংয়ের প্রাক্তন বন্ধুদের হাত ধরেই সেনার বাজিমাত

পথ দেখাল পুরনো বন্ধুই! মায়ানমারের জঙ্গলে লুকনো জঙ্গি ঘাঁটির উপরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অতর্কিত হানার পরে এমনটাই সন্দেহ এনএসসিএন-খাপলাং গোষ্ঠীর। খাপলাং বাহিনী থেকে সম্প্রতি বিতাড়িত হয়ে নাগাল্যান্ডে ফিরেছে দুই জঙ্গি নেতা ওয়াংতিং কন্যাক এবং পি তিখাক।

মায়ানমারে ঢুকে অপারেশন চালিয়ে আসার পরে কম্যান্ডোরা।

মায়ানমারে ঢুকে অপারেশন চালিয়ে আসার পরে কম্যান্ডোরা।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

পথ দেখাল পুরনো বন্ধুই!

মায়ানমারের জঙ্গলে লুকনো জঙ্গি ঘাঁটির উপরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অতর্কিত হানার পরে এমনটাই সন্দেহ এনএসসিএন-খাপলাং গোষ্ঠীর। খাপলাং বাহিনী থেকে সম্প্রতি বিতাড়িত হয়ে নাগাল্যান্ডে ফিরেছে দুই জঙ্গি নেতা ওয়াংতিং কন্যাক এবং পি তিখাক। ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি চেয়ে নতুন দল খুলেছে তারা। খাপলাং বাহিনীর সন্দেহ, নাগাল্যান্ডের তুয়েনসাং থেকে মায়ানমারের নোককাকলাক পর্যন্ত রাস্তায় কোথায় কোথায় জঙ্গিঘাঁটি, নজরদার চৌকি রয়েছে— সেই খবর ওয়াংতিংরাই সেনাবাহিনীকে দিয়েছে।

সেনা সূত্রেও এই খবরের সমর্থন মিলেছে। ওই সূত্র বলছে, মায়ানমারের জঙ্গলে কোথায় কোথায় জঙ্গি শিবির আছে, সেই খবর খাপলাংয়ের পুরনো বন্ধুরাই দিয়েছে। দিয়েছে রাস্তার হদিস। সেই খবরের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে মানচিত্র। তার পর সীমান্তের ও পারে চালকবিহীন ‘ড্রোন’ পাঠিয়ে তোলা হয়েছে জঙ্গি-গতিবিধির ছবি। পাশাপাশি জঙ্গিদের ধোঁকা দেওয়ার প্রক্রিয়াও জারি থাকে। মণিপুরে সেনা কনভয়ে জঙ্গি হানার তদন্ত শুরুর পর এনআইএ জানিয়েছিল, ওই হামলার ষড়যন্ত্র কষেছিল তিন জন— খাপলাং বাহিনীর প্রধান খাপলাং, দলের সাধারণ সম্পাদক মুলাতনু, প্রচারসচিব চাকেসাং। সেই দাবি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে যে, একদা খাপলাং-এর ঘনিষ্ঠ মুলাতনু এবং চাকেসাং তো গত বছরই জঙ্গিশিবির ছেড়ে সংঘর্ষবিরতি শুরু করেছেন! তা হলে ষড়যন্ত্রী হিসেবে তাঁদের নাম আসছে কী করে! সেনা সূত্র এখন দাবি করছে, খাপলাং জঙ্গিদের বিভ্রান্ত করতেই ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছিল। যাতে তারা সতর্ক হয়ে না পড়ে এবং সেই সুযোগে অতর্কিতে হামলা চালানো যায়।

সেই মতো সোমবার মধ্য রাতে ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে স্পেশ্যাল ফোর্সের কম্যান্ডোদের নিয়ে মায়ানমারের দিকে উড়ে যায় দু’টি এমআই ১৭ হেলিকপ্টার। মণিপুরের চাণ্ডেল ও নাগাল্যান্ডের তুয়েনসাং জেলা লাগোয়া মায়ানমার সীমান্তের কাছে নোকলাকের ওনজায় জঙ্গিদের দু’টি শিবিরই সেনাবাহিনীর ‘টার্গেট’ ছিল। সেখানে খাপলাং, কেসিপি, কেওয়াইকেএল সংগঠনের শতাধিক জঙ্গি থাকার খবর মিলেছিল। জঙ্গিশিবির থেকে কিছুটা দূরে নামানো হয় সেনা কম্যান্ডোদের। মোট ৭০ জন কম্যান্ডোর হাতে ছিল ইজরায়েলে তৈরি তেভর, টিএআর-২১ অ্যাসল্ট রাইফেল, কালাশনিকভ, মাল্টি গ্রেনেড লঞ্চার গান, মর্টার, বাজুকা, মিডিয়াম মেশিন গান। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় তৈরি ছিল সেনাবাহিনীর ধ্রুব কপ্টার, বিমানবাহিনীর সাঁজোয়া কপ্টার এমআই-৩৫। তবে আকাশপথে হানা দিলে কম্যান্ডোদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকায় তা করা হয়নি। মায়ানমার সীমান্তে ঢোকার পর কপ্টার থেকে প্যারাস্যুটে মাটিতে নেমেই ২১ প্যারা-কম্যান্ডো বাহিনীর সদস্যরা মায়ানমার সেনার একটি শিবিরের পাশ দিয়ে এগিয়ে যান। দু’দেশের মধ্যে জঙ্গি-দমন অভিযান সংক্রান্ত চুক্তি থাকায় বাধা পাননি তাঁরা।

মায়ানমারের অভ্যন্তরে জঙ্গি শিবিরের কাছাকাছি পৌঁছনোর পর রকেট হানা শুরু করে কম্যান্ডো বাহিনী। অতর্কিত হামলায় কয়েক জন জঙ্গির মৃত্যু হয়। সেনা সূত্রে খবর, বেগতিক দেখে শিবির থেকে পালানো জঙ্গিদের প্রায় ২ কিলোমিটার ধাওয়া করেন কম্যান্ডোরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দাবি, ৪৫ মিনিটের অভিযানে মোট ৩৮ জন জঙ্গি মারা গিয়েছে। নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে একাধিক শিবির।

উত্তর-পূর্বের এক সেনাকর্তা বলেন, ‘‘৫ দিন ধরে অভিযানের ছক কষা হয়। মণিপুরে সেনা কনভয়ে হামলার পরে সেনাপ্রধান দলবীর সিংহ সুহাগ সে রাজ্যে গিয়েছিলেন। তখন ৩ কোরের কম্যান্ডার ও অসম রাইফেল্স কর্তাদের সঙ্গে এই অপারেশন নিয়ে প্রাথমিক বৈঠক সেরেছিলেন তিনি।’’ সেনা সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অনুমতি পাওয়ার পরই ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের প্যারা-কম্যান্ডোরা হামলার প্রস্তুতি শুরু করেন। তবে খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মায়ানমারের সেনাবাহিনীকে খবর দেওয়া হয় একেবারে শেষ মুহূর্তে।

ভারতীয় সেনার কাছে খবর ছিল, মণিপুরে হামলায় জড়িত জঙ্গিদের গত কালই সংবর্ধনা দেওয়া হবে। সেখানে হাজির থাকবে খাপলাং বাহিনীর সেনাপ্রধান ইসাক সুমি, অর্থমন্ত্রী স্টারসন, কেসিপি সভাপতি কে লাবা মেইতেই এবং কেওয়াইকেএল চেয়ারম্যান এন ওকেন। সেই সংবর্ধনা সভাতেই হামলার ছক কষা হয়েছিল। কিন্তু ওনজা ও চাসাডের অন্য দু’টি জঙ্গি শিবিরে হানা দিলেও সংবর্ধনা সভায় সম্ভবত পৌঁছতে পারেননি কম্যান্ডোরা। ওই সেনাকর্তার মন্তব্য, ‘‘পুরো অভিযান দ্রুত শেষ করতে হয়েছে। তাই সীমান্তের ও দিকে বেশি ভিতরে ঢোকার সময় মেলেনি।’’

খাপলাং গোষ্ঠীর অবশ্য দাবি, অনুষ্ঠানস্থল তো দূর, তাদের শিবিরে আঁচড়ও কাটতে পারেনি ভারতীয় সেনা। মণিপুরের জঙ্গি সংগঠন আরপিএফ-এর সামরিক শাখারও দাবি, ভারতীয় সেনা আসলে তাদের ‘ট্রানজিট শিবিরে’ আক্রমণ করেছিল। কিন্তু পাল্টা জবাবে দিতেই তারা পালিয়ে যায়। এখন বাহিনীর মনোবল ধরে রাখতে গল্প ছড়ানো হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE