E-Paper

‘অমৃতকালেও ব্রাত্য স্বাধীনতাযোদ্ধারা’

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে বিলেতের সম্বর্ধনায় তরুণ মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী বলেন, আসল নায়ক কিন্তু অগণিত সাধারণ ভারতীয় বা শ্রমিকেরা, যাঁরা তাঁকে ভরসা দিয়েছিলেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৫১
india.

—প্রতীকী ছবি।

পুরুলিয়ার মানবাজারের চেপুয়া গাঁয়ে থাকেন ১০৫ বছরের ভবানী মাহাতো। বছরখানেক আগেও গড়গড়িয়ে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের দিনগুলির কথা বলেছেন ত্রিকালদর্শী সেই বৃদ্ধা। সেপ্টেম্বরের শেষে পুরুলিয়ার ১২টি থানা দখলের সঙ্গে জড়িত বীর যোদ্ধাদের রেঁধে খাওয়ানোর ভার যিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। ভবানীর স্বামী বৈদ্যনাথ তখন ভাগলপুর জেলে। মন্বন্তরে ক্লিষ্ট বাংলায় রোজ খেতে কাজ করে, কম-বেশি ২০-২৫ জনকে কোদো, জোয়ার রেঁধে খাইয়ে নিজের জন্য এক ফোঁটা সময় পেতেন না বছর পঁচিশের তরুণী।

কলকাতার সাম্প্রতিক একটি বক্তৃতা সন্ধ্যায় ভবানীর সঙ্গে মোলাকাতের গল্প বলছিলেন সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক পি সাইনাথ! “২০২২এ ভবানী আমাদের প্রায় নিভিয়ে দিয়েই বলেন, স্বাধীনতা-সংগ্রামী তো ছিল আমার বর! জেল খেটেছিল। আমি আন্দোলন-টনে ছিলাম না!” ভবানীর নাম ইতিহাস বইয়ে ঠাঁই পায়নি এ দেশে। অথচ ভবানী বিলক্ষণ জানতেন, কাদের জন্য কী কাজে তাঁকে প্রাণপাত করে যেতে হচ্ছে। ভবানী কিংবা আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যা, রান্নার দায়িত্বে থাকা ওড়িশার লক্ষ্মী পান্ডার মতো বীরদের টুকরো টুকরো গল্পের সূত্রেই কারা সত্যিকারের স্বাধীনতা-সংগ্রামী প্রশ্নটাও সাইনাথ ছুড়ে দিলেন! তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “ভবানী বা লক্ষ্মীরা স্বাধীনতাসংগ্রামী না-হলে কাউকেই স্বাধীনতা-সংগ্রামী বলা যায় কি?”

স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে দেশের অমৃতকাল উদযাপনকেও বিঁধতে কসুর করেননি এই প্রবীণ সাংবাদিক! তাঁর কথায়, “আজাদির অমৃত মহোৎসবের ওয়েবসাইটের প্রথম ক’পাতা দেখলে মনে হয় প্রধানমন্ত্রী মোদীই সব থেকে বড় স্বাধীনতা-সংগ্রামী! ওই ওয়েবসাইটেও জি-২০ সম্মেলন আর ৭৫ বছরকে এক করে দেখা হচ্ছে!” এখনও দেশে শতাধিক স্বাধীনতাসংগ্রামী বেঁচে আছেন বলে দাবি করে সাইনাথের আক্ষেপ, সরকারি ওয়েবসাইটে জীবিত স্বাধীনতাসংগ্রামীদের কথা নেই বললেই চলে। তাঁর অভিযোগ, “অদ্ভুত ভাবে সরকারি পোর্টাল স্বাধীনতার যুদ্ধকে ৮০০ বছরের সংগ্রামের তকমা পরাচ্ছে। সত্যিকারের স্বাধীনতাযোদ্ধা অখ্যাত সাধারণ মানুষের কথা ভুলিয়ে ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। ঔপনিবেশিক সরকারের ঢঙেই হিন্দু, মুসলিম বিভাজন সৃষ্টি করা একমাত্র লক্ষ্য!” স্বাধীনতাসংগ্রামীদের সরকারি তালিকায় ব্রিটিশের সঙ্গে সম্মুখ সমরে আত্মবিসর্জন দেওয়া একমাত্র দেশী রাজা টিপু সুলতানও ব্রাত্য।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে বিলেতের সম্বর্ধনায় তরুণ মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধী বলেন, আসল নায়ক কিন্তু অগণিত সাধারণ ভারতীয় বা শ্রমিকেরা, যাঁরা তাঁকে ভরসা দিয়েছিলেন। ১৯৩০এর গোড়ায় ভগৎ সিংহও লেখেন, আমরা বিপ্লবীরা প্রাসাদের মণিমুক্তো, কিন্তু ভিতটা জনতাই গড়ে তোলে! এই দু’টি উপলব্ধির কাছে ঋণ স্বীকার করে সাইনাথ এ দিন তাঁর সাংবাদিক-জীবন জুড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের অখ্যাত নায়কদের খোঁজার কথা বলছিলেন। পরে তাঁর গড়ে তোলা পিপলস আর্কাইভ অব রুরাল ইন্ডিয়া (পারি)-ও এই কাজের শরিক।

দেশের শেষতম জীবিত স্বাধীনতাযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপচারিতার ভিত্তিতে ‘দ্য লাস্ট হিরোজ’ বলে একটি বইও লিখেছেন সাইনাথ। তাঁর কথায়, “এই বীরদের মধ্যে দলিত, আদিবাসী, মুসলিম, নারী সবাই আছেন। কথা বলে জানি, প্রথাগত শিক্ষা নয় চেতনার দীপ্তিতেই তাঁরা স্বাধীন ভারতের সংবিধানের আদর্শও বোঝেন।” অনেক স্বাধীনতাসংগ্রামীই সরকারি পেনশন ফিরিয়ে দন। তাই পেনশন বা জেল খাটার মেয়াদ দিয়ে সব স্বাধীনতাসংগ্রামীকে চেনা যাবে না বলেও মনে করেন সাইনাথ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy