Advertisement
E-Paper

কালো টাকা থেকে ক্যাশলেস, ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল!

আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে: গেল কোথায় রাশি রাশি কালো টাকা? সবটাই কি উধাও হয়ে গেল? এক্কেবারে ভ্যানিশ! মাত্র ৩৮ দিনেই! সংখ্যাতত্বের হিসেবে ধরা পড়ল সেই ‘সুর বদলে’র ছবি!

সংবাদ সংস্থা

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৬:৫৫
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

৮ নভেম্বর, ২০১৬। সারা দেশকে অভূতপূর্ব চমক দিয়ে পাঁচশো, হাজারের নোট বাতিলের ঘোষণা করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই রাতে, তাঁর মুখে তখন কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদ ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে।

আম ভারতবাসী এমন পরিস্থিতিতে আগে কোনও দিন পড়েননি। এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিলেন, দেশের কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই বিশাল একটা কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। লণ্ডভণ্ড হতে যাচ্ছে দেশের কালো অর্থনীতি। আর এই আশা, এই ভরসা থেকেই বড় সংখ্যক মানুষ কষ্ট সয়েও সমর্থন করতে শুরু করেন মোদীর সিদ্ধান্তকে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সামনে আসতে শুরু করল এমন কিছু অর্থনৈতিক তথ্য, যা প্রাথমিক ভাবে সমর্থনকারীদেরও একটা অংশকে কালো টাকা বিলোপের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে সন্দিগ্ধ করে তুলল।

সময় যত এগোল, বোঝা গেল নোট বাতিল করে কালো টাকা বিরোধী অভিযানের যে হস্তিরূপ দর্শন করাতে চেষ্টা করছিলেন মোদী, বাস্তবে তা তৃণতুল্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। সরকারও বুঝল, কালোতে আলো ফেলে বেশি সুবিধে হবে না। তাই কালো টাকা, জাল নোট থেকে প্রধানমন্ত্রীর এবং গোটা সরকারের বক্তব্যের ভরকেন্দ্র সরতে শুরু করল ক্যাশলেস ইকনমির দিকে। এই সরতে শুরু করার দারুণ প্রমাণ প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পর পর বক্তৃতাগুলি।

৮ নভেম্বর শুরু করে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত মোদী যে যে বক্তৃতা করেছেন— তাতে ‘কালো টাকা’, ‘জাল নোট’ এবং ‘ক্যাশলেস’ এই তিন শব্দ বা শব্দবন্ধ কবে কত বার করে ব্যবহার হয়েছে, সেই সংখ্যা দেখলেই স্পষ্ট হয়, মানুষের দৃষ্টি ঘোরানোর মরিয়া চেষ্টা করে গিয়েছেন তিনি।

কালো টাকা সাফাইয়ের অভিযানটা ঢাকঢোল পিটিয়ে শুরু হয়েছিল নভেম্বরের ৮ তারিখে। বাজারে চালু ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিলের ফতোয়া জারি করতে ওই দিন ২৫ মিনিটের একটি ভাষণ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ‘কালো টাকা’ (ব্ল্যাক মানি) শব্দ দু’টি মোট ১৮ বার উচ্চারণ করেছিলেন। আর তাঁর দীর্ঘ ভাষণে ‘ভুয়ো মুদ্রা’ (ফেক কারেন্সি) শব্দ দু’টি প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন মেরেকেটে ৫ বার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সে দিন দেশের আম জনতার প্রায় সবাই বিশ্বাস করেছিলেন, কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেই বাজার থেকে আচমকা তুলে নেওয়া হচ্ছে চালু মুদ্রার ৮৬ শতাংশ। মানুষ বাহবা দিয়েছিলেন। কুর্নিশ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদীকে, ক্ষমতার কুর্সিতে বসে এমন একটা বৈপ্লবিক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার জন্য!

আরও পড়ুন- যে সাত উপায়ে ব্যাঙ্কেই সাদা হচ্ছে কালো টাকা

পরের দিন দেশের সব সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় ছাপা হল প্রধানমন্ত্রীর ছবি। তাঁকে বিস্তর কভারেজ দিল টেলিভিশন, সোশ্যাল মিডিয়া। দেশের সব ক’টি সংবাদমাধ্যমেই খবরের শিরোনাম হয়ে গেল— ‘কালো টাকার বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে নেমে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী’। ‘পেটিএম’ কাগজে কাগজে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দিয়ে পিঠ চাপড়ে দিল এই সরকারি সিদ্ধান্তের। আর ঘরে কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী চলে গেলেন জাপানে, সরকারি সফরে।

জাপান থেকে যখন দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী, তত দিনে ইংরেজি কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় কালো টাকার বিরুদ্ধে ওই অভিযানের নামটা পুরোপুরি বদলে গিয়েছে। চালু হয়ে গেল ‘ডিমনিটাইজেশন’ শব্দটি। আর হিন্দি কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেলে এন নতুন শব্দ— ‘নোটবন্দি’। দেশের সর্বত্র শুরু হয়ে গেল ‘নোট-রেশনিং’-এর ঢালাও কর্মযজ্ঞ।

‘যুদ্ধঘোষণা’ করে দিয়েই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দেশে ফেরার পর তো এ বার তা নিয়ে কিছু বলতেই হয় ‘জেনারেল’কে! বললেনও প্রধানমন্ত্রী। নভেম্বরের ১৩ থেকে ২৭ তারিখের মধ্যে ১৫ দিনে দেশের নানা প্রান্তে মোট ৬টি ভাষণ দিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তাঁর মধ্যে ছিল রেডিওয় তাঁর ‘মন কি বাত’ও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘বিদেশ-ফেরত প্রধানমন্ত্রীর সেই দু’সপ্তাহের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেওয়া ভাষণের খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখা যাচ্ছে, তাঁর ভাষণে কালো টাকার উল্লেখটা ক্রমশ কমতে শুরু করল! কোথায় কালো টাকা? প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে উত্তরোত্তর ‘কালো টাকা’র উল্লেখ কমতে লাগল! ভ্যানিশ হয়ে যেতে লাগল, উল্লেখযোগ্য ভাবে! অথচ, এই প্রধানমন্ত্রীই তাঁর গত ৮ নভেম্বরের ভাষণে ‘ভুয়ো মুদ্রা’র চেয়ে ৪ গুণ বেশি বার উচ্চারণ করেছিলেন ‘কালো টাকা’ শব্দ দু’টি।’’

তাঁদের কথায়, ‘‘৮ নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর। এই ১৫ দিনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ভাষণগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, কী ভাবে কালো টাকার উল্লেখ উত্তরোত্তর কমে গিয়েছে তাঁর মুখে! বিস্ময়কর ভাবে! ওই সময় ‘ভুয়ো মুদ্রা’ কথাটি আর তাঁর ভাষণে বলেননি প্রধানমন্ত্রী মোদী। আর ওই পর্বে তাঁর দেওয়া ভাষণে ‘কালো টাকা’র উল্লেখের চেয়ে তিন গুণ বেশি বার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘ডিজিট্যাল/ক্যাশলেস অর্থনীতি’র কথা! অথচ, গত ৮ নভেম্বর যখন কালো টাকার বিরুদ্ধে ঢাকঢোল পিটিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন প্রধানমন্ত্রী, তখন তাঁর ভাষণে এক বারের জন্যেও ‘ডিজিট্যাল/ক্যাশলেস অর্থনীতি’র উল্লেখ করেননি তিনি!’’

তা হলে কি ‘যুদ্ধ ঘোষণা’র ২০ দিনের মধ্যেই তাঁর ‘ফোকাস’টা বদলে ফেলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী? নাকি, কোনটা ‘ফোকাস’ হবে, তা ঠিকঠাক ভাবে না বুঝেই শত্রু কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইটা আচমকা শুরু করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী?

রাজনীতির অলিন্দে যাঁদের ঘোরাফেরা, তাঁরা বলছেন, ‘কালো টাকা’ শব্দ দু’টিকে বাজার থেকে হঠাৎ উধাও করে দিতে পর্দার পিছন থেকে ওই সময় দড়ি টানতে শুরু করেছিল তাঁর দল বিজেপি। আরও ভাল ভাবে বলতে হলে, আরএসএস বা গেরুয়া শিবির।

ফলে গত ৮ নভেম্বর দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ‘ডিজিট্যাল/ক্যাশলেস অর্থনীতি’র উল্লেখ এক বারও না থাকলেও তাঁর গত ২৭ নভেম্বরের ভাষণে তাঁর উল্লেখ হঠাৎ করেই বেড়ে গিয়ে ৭৩ শতাংশে পৌঁছল!

‘ভুয়ো মুদ্রা’ শব্দ দু’টির উল্লেখ প্রধানমন্ত্রীর ৮ নভেম্বরের ভাষণে ছিল ২২ শতাংশ। আর গত ২৭ নভেম্বর দেওয়া তাঁর ভাষণে ‘ভুয়ো মুদ্রা’ শব্দ দু’টি পুরোপুরি ভ্যানিশ হয়ে গেল! বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী কি তা হলে নিজেও বিশ্বাস করেন না, সন্ত্রাসকে মদত দেওয়ার ক্ষেত্রে কী বিশাল ভূমিকা রয়েছে ‘ভুয়ো মুদ্রা’র?

শুধু তাই নয়, যাঁর বিরুদ্ধে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে যুদ্ধঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী, সেই কালো টাকার উল্লেখ তাঁর ৮ নভেম্বরের ভাষণ (৮০ শতাংশ) থেকে ২০ দিনে (২৭ নভেম্বরের ভাষণ) কমে গিয়ে হল মাত্র ২৭ শতাংশ! তা হলে ‘ফোকাস’টা রইল কোথায়?

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ‘‘আসলে কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা লড়তে নামেননি প্রধানমন্ত্রী মোদী। দেশে ‘ক্যাশলেস অর্থনীতি’কে চাঙ্গা করে তুলতেই সাদা, কালো, সব চালু মুদ্রার বিরুদ্ধেই যুদ্ধঘোষণা করে বসেছেন তিনি!’’

তা হলে কি কালো টাকার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জেহাদ ঘোষণাটা আদতে দেশে জোরালো ভাবে ক্যাশলেস অর্থনীতি কায়েমের লড়াই হয়ে গেল?

Cashless Economy Fake Currency Black Money Narendra Modi Demonetisation
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy