দেওয়ালির দিন সেনার সঙ্গে। বুধবার লুধিয়ানার কাছে হলওয়ারার বিমানঘাঁটিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পাশে বায়ুসেনা প্রধান অরূপ রাহা। ছবি: পিটিআই।
লালকৃষ্ণ আডবাণীদের বিদ্রোহ সামাল দিতে গত কালই তিন প্রাক্তন সভাপতিকে আসরে নামিয়েছিল বিজেপি। তাঁদের পাল্টা বিবৃতিতে কারও নাম না-করা হলেও এটা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও দল যখন হারতো তখন যৌথ দায়িত্বের কথাই বলা হতো। যে বক্তব্যের নির্যাস একটাই, বিহারে বিপর্যয়ের জন্য পরোক্ষে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ জুটিকে দায়ী করে ঠিক করেননি আডবাণীরা। এই রাখঢাকটুকু অবশ্য রাত পোহাতেই ঘুচে গিয়েছে। আজ বিদ্রোহী শিবিরের উপর রীতিমতো পাল্টা বোমাবর্ষণ শুরু হয়েছে মোদী-অমিতের প্রচ্ছন্ন নেতৃত্বে। যদিও তার আড়ালেই চলছে প্রবীণ নেতাদের বুঝিয়েসুজিয়ে পথে আনার চেষ্টা। নরম-গরমের এই কৌশলেই আডবাণীদের বিদ্রোহের মোকাবিলা করতে চাইছে মোদী শিবির।
তবে যে ভাবে একের পর এক নেতা আজ খোলাখুলি আডবাণীদের বিবৃতির বিরোধিতা করেছেন, তাতে অনেকেরই কটাক্ষ, বিজেপির কংগ্রেসিকরণ এ বার সম্পূর্ণ হল! ইন্দিরা গাঁধীর আমল থেকে গাঁধী-নেহরু পরিবারের বিরুদ্ধে দলের কোনও নেতা সরব হলে ঠিক এ ভাবেই পাল্টা আক্রমণে বিদ্রোহ দমন করার চেষ্টা হতো। হাইকম্যান্ডের নির্দেশে ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা প্রকাশ্যে তুলোধোনা করতেন বিদ্রোহী নেতাকে। প্রমাণ করে দেওয়া হতো, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর নেহাতই সংখ্যালঘু। দল সামগ্রিক ভাবে শীর্ষ নেতৃত্বের পাশেই আছে।
ঠিক সেই পন্থাতেই আজ আডবাণীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন বিজেপি নেতারা। গত কাল রাজনাথ সিংহ, বেঙ্কাইয়া নায়ডুর সঙ্গে বিবৃতি দেওয়া প্রাক্তন বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ী আজ এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি সভাপতি অমিত শাহকে বলেছি, যাঁরা এ ধরনের মন্তব্য করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।’’ অন্য দিকে আরএসএস থেকে বিজেপিতে আসা রাম মাধব আডবাণীদের কার্যত ‘দলবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘‘যাঁরা এ ধরনের মন্তব্য করছেন, তাঁরা কি দলের ভাল করছেন না ক্ষতি? এই প্রবীণ নেতারা যা বলতে চান, সেটি বলার জন্য উপযুক্ত মঞ্চ রয়েছে। সেখানে তাঁদের বলা উচিত।’’
শুধু গডকড়ী বা রাম মাধবের মতো দরের নেতারাই নন, ভোলা সিংহ-ভরত সিংহের মতো সাধারণ সাংসদরাও আজ গলা তুলেছেন আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী, যশবন্ত সিন্হা, শান্তা কুমারদের বিরুদ্ধে। তাঁদের হুমকি, ‘‘লালকৃষ্ণ আডবাণী যদি তাঁর বিবৃতি প্রত্যাহার না করেন, তা হলে বিজেপি সাংসদরা তাঁর বাড়ির সামনে ধর্না দেবেন। নরেন্দ্র মোদীর দৌলতেই আজ বিজেপি এই জায়গায় এসেছে। দিল্লি ও বিহারে পরাজয় হলেও চারটি রাজ্যে দল জিতেছে। গোটা বিশ্বে ভারতের নাম উজ্জ্বল হয়েছে। এই প্রবীণ নেতারা কি সেগুলি উপেক্ষা করতে পারেন?’’ ভরত সিংহের দাবি, জনা পঞ্চাশ সাংসদের সঙ্গে তিনি ইতিমধ্যেই কথা বলে ফেলেছেন।
কিন্তু বিজেপি সূত্রই বলছে, আডবাণীরা যা বলেছেন, সেটা তাঁদের একার কথা নয়। মোদী-অমিত শাহ জুটি যে ভাবে দল চালাচ্ছেন, তাতে অনেক নেতাই অখুশি। শুধু তা-ই নয়, জনমানসেও এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব উদ্ধত। সেই ভাবনায় ইন্ধন জুগিয়েছে বিরোধী দলগুলি। তাদের অভিযোগ, মোদী সরকার বুলডোজার দিয়ে প্রশাসন চালাতে চায়। বিরোধীদের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনাতেই তারা নারাজ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গো-মাংস এবং অসহিষ্ণুতার প্রসঙ্গ। ফলে যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মোদী ক্ষমতায় এসেছিলেন, ১৭ মাস পরে তাতে এখন ভাটার টান। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন আডবাণীরা। মোদীর বিরুদ্ধে তাঁদের অসন্তোষ দীর্ঘদিনের হলেও এত দিন তাঁরা বিশেষ মুখ খোলেননি। বিহারে ভরাডুবির পরে আজ যখন মোদীর পায়ের তলার মাটি কিঞ্চিৎ টলোমলো, তখনই আক্রমণে গিয়েছেন তাঁরা।
এখন প্রশ্ন হল, দলেই যদি মোদী-অমিতের বিরুদ্ধে অসন্তোষ থেকে থাকে, তা হলে একের পর এক নেতা আডবাণীদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিচ্ছেন কেন? বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, পরিস্থিতি তো এমন নয় যে এখনই মোদী-অমিতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়ে যাবে। দলে তাঁদের অবস্থান যথেষ্ট মজবুত। ফলে তাঁরা যদি কাউকে বিবৃতি দিতে বলেন, সেটা উপেক্ষা করা কঠিন। রাজনাথ সিংহের মতো নেতারা আডবাণীদের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিলেও আসলে তাঁরাও একই মনোভাব পোষণ করেন। সুষমা স্বরাজও কৌশলগত ভাবে নীরব রয়েছেন। কংগ্রেসেও ঠিক এমনটাই ঘটত। ক্ষমতার রাজনীতি চিরকালই নীতির রাজনীতির থেকে সবল।
আডবাণী শিবির যে এই সত্যিটা জানে না তা নয়। তাই আজ ক্ষমতাসীন শিবিরের আক্রমণের উত্তরে নতুন করে কোনও বিবৃতির পথে তাঁরা যাননি। তাঁরা দেখতে চান জল কোথায় গড়ায়। মোদী অন্তত আরও চার বছর ক্ষমতায় আছেন। ফলে বিক্ষোভকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সময় এটা নয়। এক বিক্ষুব্ধ নেতার কথায়, ‘‘সবে তো আড়মোড়া ভাঙা হল। আসল লড়াই এখনও বাকি।’’
তবে প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও ঘনিষ্ঠ মহলে মোদী শিবিরের দেওয়া যুক্তি খারিজ করেছেন বিদ্রোহী নেতারা। বিভিন্ন নেতাকে দিয়ে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব যে কথাটা বলানোর চেষ্টা করেছেন তা হল, বাজপেয়ী জমানাতেও ভোটে হার হলে যৌথ দায়িত্বের কথা বলা হতো। আডবাণী শিবিরের বক্তব্য, তখন বাজপেয়ী ইস্তফা দেওয়ার ইচ্ছাটা অন্তত প্রকাশ করতেন। কিন্তু এখন যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁরা সব দায় ঝেড়ে ফেলতেই ব্যস্ত। অথচ দল জিতলে এঁরাই কৃতিত্ব নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি করতেন! তা ছাড়া, বিষয়টা শুধু একটা রাজ্যে হার-জিতের নয়। যে ভাবে দল চালানো হচ্ছে, তাতে যে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ পাচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই আডবাণীরা মুখ খুলেছেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি। তাঁরা বলছেন, দলে যদি ভিন্নমত শোনার কোনও ব্যবস্থা থাকত, তা হলে সেই মঞ্চেই প্রসঙ্গটা তোলা হতো। কিন্তু সংসদীয় বোর্ড থেকে তো প্রবীণ নেতাদের বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই বিবৃতি দিতে হয়েছে।
আডবাণীদের বিদ্রোহকে লঘু ভাবে না-নেওয়ার পক্ষপাতী বিজেপির একটা বড় অংশও। দলের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, ‘‘পাথরের ওপর জল পড়লে গোড়ায় গোড়ায় মনে হয়, কী-ই বা এমন ক্ষতি হবে! কিন্তু লাগাতার জল পড়তে থাকলে পাথরও ক্ষয়ে যায়। মোদী ক্ষমতাশালী বলে যাবতীয় বিরোধী কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করাটা মোটেই উচিত কাজ হবে না। তাতে দলেরই ক্ষতি।’’
প্রবীণদের উপেক্ষা করে চলার ফল যে ভাল হবে না, সেটা মোদীও বুঝতে পেরেছেন বলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি। বিহারের ফল যে দিন বেরোয়, সে দিনই ছিল আডবাণীর জন্মদিন। সাতসকালেই শুভেচ্ছা জানাতে তাঁর বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন মোদী এবং অমিত শাহ। এই পদক্ষেপের পিছনে আডবাণীর ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা ছিল বলেই বিজেপি সূত্রের দাবি। কিন্তু সে দিন দুই শীর্ষ নেতার শরীরী ভাষাই বলে দিয়েছিল, ফারাক কত দুস্তর। এর পরেও আডবাণীরা যাতে বিবৃতি না-দেন, তার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। দলের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন আরএসএস নেতা কৃষ্ণগোপাল। সুষমার সঙ্গেও দেখা করেন তিনি। তাতে অবশ্য বিবৃতি প্রকাশ বন্ধ করা যায়নি।
এখন আডবাণীরা বোমা ফাটানোর পরে নরমে-গরমে চলার নীতিই নিয়েছে মোদী শিবির। এক দিকে বিভিন্ন নেতাকে দিয়ে বিবৃতি দিইয়ে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, বিদ্রোহীরা সংখ্যালঘু। অন্য দিকে, দলের সাংগঠনিক নেতা রামলালকে পাঠানো হয়েছে আডবাণীর সঙ্গে কথা বলতে। বিজেপি নেতারা বলছেন, সামনে সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। বিহারে জয়ের পরে উজ্জীবিত বিরোধীরা সেখানে শাসক দলকে বিপাকে ফেলতে চাইবেন। রাম জেঠমলানী, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, অরুণ শৌরি, গুরুমূর্তির মতো নেতারা তাঁদের ইন্ধন দিতে পারেন বলে আশঙ্কা। অথচ এঁরা কেউ দল-বিরোধী নন। শুধু উপেক্ষিত হয়ে থাকার কারণে ক্ষুব্ধ। ফলে এঁদের ক্ষোভ প্রশমন করে সঙ্গে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আডবাণীদের বিদ্রোহে দলের উপরে নিয়ন্ত্রণ টোল খায়নি, প্রকাশ্যে এ কথা বোঝানোর চেষ্টার পাশাপাশি একান্তে প্রবীণ নেতাদের মানভঞ্জনই আপাতত রণকৌশল মোদীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy