Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
বসছে নালিশের বাক্স

পাঁচ ভিডিওর ধাক্কায় চাপে সেনাপ্রধান

মুখ খুলতে হল খোদ সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়তকে। জওয়ানদের উদ্দেশে বলতে হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, অভিযোগ থাকলে জানান ‘কমপ্লেন বক্স’-এ। গোপনই থাকবে পরিচয়। এটা ঘটল পাঁচটা ভিডিওর ধাক্কায়।

বিপিন রাওয়ত

বিপিন রাওয়ত

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:৫৭
Share: Save:

মুখ খুলতে হল খোদ সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়তকে। জওয়ানদের উদ্দেশে বলতে হল, সোশ্যাল মিডিয়ায় নয়, অভিযোগ থাকলে জানান ‘কমপ্লেন বক্স’-এ। গোপনই থাকবে পরিচয়। এটা ঘটল পাঁচটা ভিডিওর ধাক্কায়।

ভিডিও ১: সকালে পরোটা-চা। দুপুরে পাতলা ট্যালটেলে ডাল আর রুটি। রাতে না খেয়েও শুতে পড়তে হয় হামেশাই। অভিযোগ, বরাদ্দ খাবার কর্তারা বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। দিন কয়েক আগে পাক সীমান্তে নিযুক্ত বিএসএফ কনস্টেবল তেজ বাহাদুরের পোস্ট করা এই ভিডিও ঘিরে তোলপাড় সোশ্যাল মি়ডিয়া। অস্বস্তিতে পড়ে বিএসএফ কর্তারা তাঁর মানসিক স্থিরতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তড়িঘড়ি তদন্তের নির্দেশ দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। প্রধানমন্ত্রীর দফতরও রিপোর্ট চায় তাঁর মন্ত্রকের কাছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আজ সেই রিপোর্ট দিয়েছে। বিএসএফের দাবি, জওয়ানদের রেশন চুরি হচ্ছে কি না বা সরবরাহ ব্যবস্থায় খামতি রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।

ভিডিও ২: সিআরপিএফ জওয়ান জিৎ সিংহের দাবি, সেনার মতো একই কাজ করে আধাসেনার সুযোগসুবিধা ও বেতন অনেক কম। নেই বিনামূল্যে চিকিৎসার সুবিধা। বিশ বছরের চাকরি জীবন শেষে পেনশনও পান না। সিআরপিএফ-এর ডিজি দুর্গা প্রসাদের বক্তব্য, ‘‘ওই জওয়ান কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেননি। তাঁর ক্ষোভের কারণগুলি যথেষ্ট আলোচিত। সপ্তম বেতন কমিশনের কাছে আমরাও এগুলি জানিয়েছিলাম।’’

ভিডিও ৩: দেহরাদূনের ৪২ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের ল্যান্স নায়েক যজ্ঞপ্রতাপ সিংহ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাড়ে পনেরো বছর ধরে সেনাবাহিনীতে দেখছি, সেনাকর্তারা কী ভাবে অধস্তনদের হেনস্থা করেন। প্রতিবাদ করলে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর হুমকি দেন।’’ গত জুনে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে চিঠি লিখেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জবাবদিহি চেয়ে চিঠিও আসে সেনার কাছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখার বদলে তাঁর উপরেই অত্যাচার চালান সেনাকর্তারা। যজ্ঞপ্রতাপের দাবি, ‘‘অন্য কেউ হলে আত্মহত্যা করতেন বা ওই অফিসারদের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপ করতেন। উর্দির সম্মান রাখতেই আমি তেমন কিছু করিনি।’’

ভিডিও ৪: মুখ ঢেকে সশস্ত্র সীমা বলের এক জওয়ানের অভিযোগ, বাজে খাবার নিয়ে বিএসএফের তেজ বাহাদুরের অভিযোগ একশো ভাগ খাঁটি। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘আমাদের কাজ সীমান্ত পাহারা দেওয়া। অফিসারদের ছেলেমেয়েদের দেখভাল বা বাসন মাজা নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দেখুক।’’

ভিডিও ৫: সেনাবাহিনীতে রেশন নিয়ে কালোবাজারির অভিযোগ তুলে ভিডিওটি পোস্ট করেন বিএসএফের এক অবসরপ্রাপ্ত ইনস্পেক্টর। বক্তব্য, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলায় নির্ধারিত বয়সের ১০ বছর আগেই অবসর নিতে হয় তাঁকে।

জওয়ানদের এই ‘ভিডিও-স্ট্রাইক’-এর মোকাবিলায় সেনাপ্রধান রাওয়ত আজ বলেন, ‘‘আমি নির্দেশ দিয়েছি, সর্বত্র চিফ অব আর্মি স্টাফ বক্স বসানো হবে। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগ জরুরি। যে সেনা জওয়ান ভিডিও পোস্ট করেছেন, তাঁর সহায়কের কাজে আপত্তি রয়েছে। এই ধরনের কাজে কাউকে জোর করা ঠিক নয়।’’ কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘বাহিনীর মধ্যেই ক্ষোভ নিরসনের সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া দুই ধারওয়ালা তরোয়াল। ক্ষোভ প্রকাশের এই পন্থা ঠিক নয়।’’

‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর পরে সেনার বীরগাথা গেয়ে জাতীয়তাবাদের আবেগ উস্কে দেওয়ার চেষ্টায় নেমেছিল বিজেপি। জওয়ানদের প্রতি দরদের প্রমাণ দিতে সপ্তম বেতন কমিশন ও এক পদ, এক পেনশন চালু করার কথাও তুলে ধরছিল। কিন্তু পাঁচটি ভিডিও-ই জল ঢেলে দিয়েছে বিজেপির প্রচারে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে ভারতীয় জওয়ানদের দুর্দশা এখন আন্তর্জাতিক স্তরেও বড় খবর ও চর্চার বিষয়। বিষয়টি স্পর্শকাতর বুঝে মোদী সরকার জওয়ানদের শাস্তি দেওয়ার পথে হাঁটেনি। উল্টে বোঝাতে চাইছে, তারা জওয়ানদের সমস্যার কথা সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে চায়। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে চায়।

বাহিনীতে শৃঙ্খলার গুরুত্ব বুঝে রাজনৈতিক দলগুলিও খুব একটা হইচই করছে না এ নিয়ে। তবে কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সুরজেওয়ালা সরকারকে বিঁধতে ছাড়েননি। বলেছেন, ‘‘ওই ভিডিও থেকে মোদী সরকারের প্রতি জওয়ানদের অনাস্থা ও উদাসীনতাই স্পষ্ট।’’ ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ভেঙে সেনা-অভিযানকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করতে গিয়েছিল মোদী সরকার। জওয়ানরাই এখন অস্বস্তিতে ফেলছে সরকারকে। বিজেপির পাল্টা যুক্তি, মোদীর অনেক আগেই ইন্দিরা গাঁধী ১৯৭১-এ বাংলাদেশ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

তবে শৃঙ্খলার প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে বলতেই হচ্ছে কোনও জওয়ান বা অফিসার নিজের ছবি বা ভিডিও পোস্ট করতে চাইলে অনুমতি নিতে হয়। অন্য কোনও ছবি তুলে তাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে পারেন না। নিরাপত্তার খাতিরেই এই নিয়ম। এ বার তা আরও কঠোর ভাবে কার্যকর হবে।

কিন্তু এর পরেও ছ’নম্বর কোনও ভিডিও সামনে এলে? উদ্বেগে সরকার। বাহিনীগুলির কর্তারাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Complain box Bipin Rawat Five videos
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE