সাধারণ সম্পাদক হিসেবে লোকসভা ভোটে সিপিএমের ভরাডুবির সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। কিন্তু রাহুল গাঁধী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সরাসরি ইস্তফার কথা বললেন না।
এ বার লোকসভা ভোটে বাংলা, কেরল, ত্রিপুরা— তিন রাজ্যেই সিপিএম মুখ থুবড়ে পড়েছে। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ইয়েচুরি নিজের ইস্তফার কথা বললে, বাংলা, কেরল, ত্রিপুরার রাজ্য নেতাদের গদিও নড়বড়ে হয়ে যায়। ইয়েচুরি তাই সে পথে হাঁটেননি। লোকসভা ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে রবিবার ও সোমবার সিপিএমের পলিটবুরোর বৈঠক বসেছিল। সেই বৈঠকে ইয়েচুরি তাঁর কমরেডদের বলেছেন, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই ফলের দায় তাঁর উপরেই বর্তায়। তিনি সে দায় নিচ্ছেন।
আজ পলিটবুরোর বৈঠক শেষে ইয়েচুরি বলেন, ‘‘আমি ফল প্রকাশের পরেই দায়ের কথা বলে দিয়েছিলাম। আমি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিচ্ছি। সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পলিটবুরোর শীর্ষ নেতৃত্ব সমষ্টিগত ভাবে কাজ করে। পলিটবুরোয় সকলে সমান হলেও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি প্রথম। তাই আমি দায়িত্ব নিচ্ছি।’’
আগামী মাসে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক বসবে। সেখানেও ইয়েচুরি যদি ইস্তফার কথা মুখে না বলে অন্তত ইঙ্গিতও করেন, তা হলেও পলিটবুরোর কেউই তা মানতে চাইবেন না। কারণ ইয়েচুরি ইস্তফা দিতে চাইলে বাংলার সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে কেরলের কোডিয়েরি বালাকৃষ্ণণ বা ত্রিপুরার গৌতম দাশদের ইস্তফার কথা বলতে হয়। সকলের অবস্থানই নড়বড়ে যাবে।
এর আগে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা হারানোর পরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলীয় পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। ২০১৮-র পার্টি কংগ্রেসের আগে ইয়েচুরির কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধার রাজনৈতিক লাইন ভোটাভুটিতে হেরে গেলে তিনিও ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। এ বার হারের পরেও ইয়েচুরি বা অন্যরা ইস্তফা দিতে রাজি না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি দলের নেতাদের সমষ্টিগত ভাবে নিজেদের গদি বাঁচানোর চেষ্টা?
পলিটবুরোর বিবৃতিতে আজ মেনে নেওয়া হয়েছে, সিপিএমের দুর্গে বিপুল ক্ষয় হয়েছে। ইয়েচুরি যুক্তি দিয়েছেন, হাতে গোনা কয়েকটি বাদে সব বিরোধী দলই ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু বাস্তব হল, বাকি বিরোধী দলগুলি বামেদের মতো ধাক্কা খায়নি। জাতীয় স্তরে সিপিএম-সিপিআইয়ের ভোটের ভাগ ছিল ৭ শতাংশ। ২০১৪-য় তা নেমে এসেছিল ৪ শতাংশে। এ বার তা ২.৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
ইয়েচুরির যুক্তি, এ বার নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিত্বকে তুলে ধরতে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছে। বিপুল পরিমাণ তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে আমজনতার কাছে নিয়মিত বার্তা পাঠানো হয়েছে। একেবারে নিচু স্তরে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ করে যাদব ছাড়া ওবিসি ভোট, জাটভ ছাড়া দলিত ভোট এককাট্টা করেছে বিজেপি। সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী উগ্র দেশপ্রেমকে হাতিয়ার করে প্রচার করা হয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই’। নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানিয়েও ফল মেলেনি। আরএসএস-এর সংগঠনের জালও এতে সাহায্য করেছে। ইয়েচুরি বলেন, ‘‘কোনও জোটেই কাজ হত না। কারণ ২০০-র বেশি আসনে বিজেপি ৫০ শতাংশর বেশি ভোট পেয়েছে।’’
কিন্তু পলিটবুরোর বৈঠকে বাংলার নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে না-পারা নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন। বামেরা যে দু’টি আসনে প্রার্থী দেয়নি, সেখানেই কংগ্রেস জিতেছে। সূর্যকান্ত মিশ্ররা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, জোট হলে লড়াই করা যেত। কিন্তু তা না-হওয়ায় মেরুকরণের মুখে বাম ভোটে ক্ষয় হয়েছে। তৃণমূল সরকারের আট বছরের কাজকর্মে মানুষের ক্ষোভের ফায়দা তুলেছে বিজেপি। কেরলের নেতারা আবার নালিশ জানিয়েছেন, জাতীয় স্তরে দলের নেতৃত্ব কংগ্রেসের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনের মনোভাব নেওয়ায় কেরলে পুরো মুসলিম ভোট কংগ্রেসের দিকে চলে গিয়েছে।