Advertisement
E-Paper

রাস্তা থাকলে মেয়েটা বাঁচত, জঙ্গল কাটছেন ওঁরা

পাহাড় যদি দাঁড়ায় পথ আগলে, সরাতে হবে।জঙ্গল যদি জড়িয়ে যায় পায়ে, নামতে হবে কুড়ুল হাতে। জান বাঁচাতে হবে তো! পথটা প্রথম দেখিয়েছিলেন দশরথ মাঝি। পাহাড় ডিঙিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি স্ত্রীকে। মারা যান ফাগুনিয়া।

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:০২
জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করছেন গ্রামবাসীরাই।— নিজস্ব চিত্র

জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করছেন গ্রামবাসীরাই।— নিজস্ব চিত্র

পাহাড় যদি দাঁড়ায় পথ আগলে, সরাতে হবে।

জঙ্গল যদি জড়িয়ে যায় পায়ে, নামতে হবে কুড়ুল হাতে।

জান বাঁচাতে হবে তো!

পথটা প্রথম দেখিয়েছিলেন দশরথ মাঝি। পাহাড় ডিঙিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি স্ত্রীকে। মারা যান ফাগুনিয়া। পাহাড়ের এত দর্প! বাইশ বছর ধরে একা সেই পাহাড় কেটে রাস্তা করেছিলেন বিহারের ‘মাউন্টেন ম্যান’ দশরথ।

এ বার জঙ্গলের মধ্যে রাস্তা করতে নেমে পড়েছেন পলামুর গোটা আটেক গ্রামের মানুষ। গত ১০ সেপ্টেম্বর বছর তেরোর আরতি কুমারীর মৃত্যু তাঁদের ঝাঁকুনি দিয়ে গিয়েছে। স্থানীয় মিটার গ্রামের মেয়েটি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। রাস্তা না থাকায় ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়নি তাকে। রাস্তাতেই মারা যায় আরতি।

আগে হলে হয়তো শুধু হা-হুতাশ করেই ক্ষান্ত হতেন পরিজনেরা। কিন্তু দশরথ চোখ খুলে দিয়েছেন যে! তাই ডালটনগঞ্জ থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে ঘেরা মিটার আর তার আশপাশের প্রত্যন্ত গ্রামের লোকজন নেমে পড়েছেন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা বের করতে। মাটি কেটে অনেকটা রাস্তা তৈরি করেও ফেলেছেন ইতিমধ্যে।

খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসনও। এত দিন ধরে উপেক্ষিত মানুষগুলোর চাহিদা মেটাতে একশো দিনের প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ওই রাস্তা তৈরির কাজকে।

কাঁচা রাস্তা পাকা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনাকে কাজে লাগানো যায় কি না তা নিয়েও চলছে আলোচনা।

আসলে আরতির মৃত্যুর দিনটা ভুলতে পারছেন না অনেকেই। তার আত্মীয় মুন্নি কুমারী জানায়, কয়েক দিন ধরে আরতির প্রবল জ্বর চলছিল। শেষে ডালটনগঞ্জে সদর হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ডাকা হয়। কিন্তু গ্রাম থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে পাকা রাস্তা পর্যন্ত এসেই অ্যাম্বুল্যান্স চালক জানিয়ে দেন, রাস্তা নেই। গ্রাম পর্যন্ত গাড়ি যাবে না। রোগীকে পাকা রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে আসতে হবে। ধুম জ্বরের মধ্যেই আরতিকে সাইকেলে চাপিয়ে পাকা রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। মুন্নি বলেন, ‘‘সাইকেলে আসতে আসতেই ও নেতিয়ে পড়েছিল।

পাকা রাস্তায় পৌঁছে অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে আরতিকে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, ততক্ষণে ও মারা গিয়েছে। ডাক্তারেরা বললেন, আরও আগে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো বাঁচানো যেত।’’

আরতির এই মৃত্যু নাড়া দিয়েছে গোটা তল্লাটকে। তাঁরা বুঝেছেন, কিছু একটা না করলে মৃত্যু ছোবল দিতে পারে যে কোনও বাড়িতে। গ্রামবাসী মনোজের কথায়, ‘‘এই রাস্তা তৈরির জন্য আমরা অনেক বার পঞ্চায়েতের কাছে আবেদন করেছি। কোনও ফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত আরতিই রাস্তা দেখিয়ে গেল।’’

প্রথমে মিটার গ্রামের মানুষ ঠিক করেন, আপাতত জঙ্গল কেটে কাঁচা রাস্তাই তৈরি করবেন। পরে তা শুনে আশপাশের শোন, পুরান্ডি, কর্মা, শিলদা, গিতাহারের মতো পড়শি গ্রামের মানুষও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমে পড়েছেন।

এত দিনে রাস্তা হয়নি কেন? কেন নড়ে বসেনি সরকারি জগদ্দল?

তার একটা ব্যাখ্যা হল, ঝাড়খণ্ডে পলামু জেলার মাওবাদী প্রভাবিত এই প্রত্যন্ত গ্রামগুলি জঙ্গলের মধ্যে কার্যত বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘জঙ্গলের মধ্যে পায়ে চলা যে রাস্তাটুকু রয়েছে তা-ও এই বর্ষায় শেষ। মাওবাদীদের আতঙ্কে প্রশাসনও এখানে উন্নয়নের কাজ করতে ভয় পায়।’’

গ্রামবাসীরা এগিয়ে আসায় অবশ্য ভয় ভেঙেছে প্রশাসনের। ওই এলাকা তারহাসি ব্লকের মধ্যে পড়ে। পলামুর জেলাশাসক অমিত কুমার জানান, তারহাসির বিডিওকে এলাকায় যেতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘রাস্তার কাজ একশো দিনের কাজের প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছি। তাতে যাঁরা রাস্তা কাটছেন তাঁরা সরকারি হারে মজুরিও পাবেন।’’

দশরথ করেছিলেন একা। ওঁরা দশে মিলে। কাজটা একই।

জান বাঁচাতে হবে তো!

Bihar malignant malaria Road
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy