Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Haryana Violence

‘বাছাই’ দোকানই পুড়ে ছাই, গুরুগ্রাম ভাল নেই

কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে যেমন রহস্যময় ভাবে এসেছিল, সে দিন তেমন ভাবেই ফিরে গিয়েছিল লাল গামছায় মুখ ঢাকা যুবকেরা।

gurugram.

গুরুগ্রামে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দোকান। ছবি: পিটিআই।

অগ্নি রায়
গুরুগ্রাম শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৩ ০৭:১৯
Share: Save:

লাল গামছা দিয়ে মুখ সম্পূর্ণ ঢাকা। হাতে মোটা লোহার রড। খোলা শুধু চোখ দু’টো, যেন জ্বলছে। তবে তারা একেবারে নিস্পন্দ। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে।

তারা ও রকম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কেন, কারও নির্দেশের অপেক্ষায় কি না, সে সমস্ত বোঝার মতো সাহস সে দিন ছিল না আফরিনদের। মেরেকেটে উপরের এই বর্ণনাটুকুই দিতে পারছেন তিনি। বাদশাপুর এলাকার সেক্টর ৬৬-র হাইওয়ের পাশে ঢালু জমিতে একটি মাত্র মণিহারি ‘লালা’র দোকান। তারপরেই শ’দেড়েক টিনের ঘর নিয়ে বাঙালির ‘বস্তি’। যেখানে ঢুকতে বা বেরোতে গেলে, ওই লালা-র দোকানই কার্যত প্রবেশদ্বার।

সে দিন দুপুরে নিকটবর্তী বহুতলের কয়েকটি ফ্ল্যাটে ঠিকে কাজ সেরে ফেরার পথে লালার দোকানের সামনে এই অপরিচিত দৃশ্য দেখে বুকের লাবডুব বেড়ে দিয়েছিল ওঁদের। দৌড়ে হোঁচট খেতে খেতে ফিরে দেখেন, সবার দরজা আঁটা। যেন শোলে ছবিতে গব্বরের দলবল ঢোকার ঠিক আগের রামগড় গ্রাম। পরে আফরিন শোনেন, সকালেই ঠিকেদার এসে বলে গিয়েছিল মুরুব্বিদের ডেকে, কেউ যেন আজ চৌকাঠ না পার হয়। হলে ‘খবর’ আছে। দেড় কিলোমিটার দূরে বড় রাস্তার উপরে কাদরপুরের বাজারে ততক্ষণে প্রকাশ্য দিবালোকেই আগুন লাগানো হয়েছে। সেই ধোঁয়া এখনও কাটেনি। ফলে এর পরে কী হবে, কেউ জানেন না।

সেই আতঙ্কের দিন-রাত ওঁরা পার করেছেন চার-পাঁচ দিন হল। আজও থমকে আছে মালদা-দিনাজপুর থেকে আসা এই মুসলিম ‘বস্তি’। সেখানকার কয়েক জনই বললেন, “পরশু রাতে পুলিশ এসেছিল সবার ঘরে ঘরে। নমাজ পড়তে যেতে নিষেধ করছে কয়েকদিন। এখানে আবার মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি। আগে কখনও কোনও অশান্তি হয়নি এখানে। কিন্তু এখন কয়েকদিন না যাওয়াই মঙ্গল। আমরা বাঙালিরা নমাজ পড়তে যাইনি এই জুম্মাবারে।”

কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে যেমন রহস্যময় ভাবে এসেছিল, সে দিন তেমন ভাবেই ফিরে গিয়েছিল লাল গামছায় মুখ ঢাকা যুবকেরা। আফরিনের গ্রাম আজও জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও, সেই বাহিনী জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে বাদশাপুর কাদরপুরের বিশেষ বিশেষ কিছু দোকান। যা সরেজমিনে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আগে থেকে এসে এই জনবহুল এবং দোকানবহুল বাজারকে ভাল করে রেইকি করে গিয়েছিল আক্রমণকারীরা।

আব্দুল মজিদ মিট হাউস এই প্রাচীন বাজারের প্রায় সমবয়সি। উত্তরপ্রদেশের ফিরোজাবাদ থেকে উঠে আসা মজিদ পরিবারের তিন পুরুষের দোকান। এখন তার সামনে ড্রাম, ভাঙা কাঠ, জঞ্জালের স্তুপ, নামের বোর্ডও ঝুলন্ত এবং ভাঙা। কিছু ধ্বংসাবশেষ পুলিশ সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তার দু’টো দোকান ছেড়েই আস মহম্মদ ফ্রেশ হালাল মিট। সেটিও বিধ্বস্ত। মাঝের হরি সিংহের মোবাইল আর বিকাশ ভাটের পুরনো ফ্যান, সেলাই কলের মেশিন মেরামতির দোকান অবশ্য সম্পূর্ণ অক্ষত। হামলা যে দিন হয়, সে দিন তা ঘটেছিল ১০ ফুট দূরত্বের দোকানে বসা বিকাশের চোখের সামনেই। ‘‘সে দিন ছিল মঙ্গলবার। সব মাংসের দোকান ওই দিন বন্ধ থাকে। ফলে মজিদ জানে বেঁচে গিয়েছে, কিন্তু ভয়ে আর আসেনি। আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে দেশে চলে গিয়েছে। এই বাজারে আমার এত দিনের প্রতিবেশী, কিন্তু সে দিন ভয়ে টুঁ শব্দ করতে পারলাম না।"— মুসলিম বন্ধুটির জন্য আক্ষেপ মাঝবয়সি বিকাশের।

ওই রাস্তা ধরে বাজারকে বাঁ দিকে রেখে আরও এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ব্যারিকেড বাড়ছে। জিপের ঘন ঘন টহলদারি, অস্থায়ী পোস্ট। আর দু'পাশে দিব্যি আস্ত বিপণির পাশে পাশে দোকানের কঙ্কাল। কোথাও কিছু টিনের শিট মাটিতে পড়ে আছে, কোথাও বেঁকে-চুরে রয়েছে ঝামা হওয়া রড। তোশক-বালিশ-গদির বাজারে ঠিক তিনটি দোকান এমনই ঝামা হয়ে যাওয়া তুলো আর কাপড়ের ছাই। পোড়া দাগ শুধু। প্লাজা, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, তথ্যপ্রযুক্তির টাওয়ারের ফাঁকে ফাঁকে এই ধ্বংসস্তুপ যেন আরও বেশি করে চোখে লাগে।

এ রকমই একটি জ্বলে যাওয়া ধাবার সামনে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে গল্প করছেন মাধো ঠক্কর, অমর বর্মারা। বয়স বছর বিশের আশেপাশে। এরা এই হোটেলে কাঁচামালের জোগান দিতেন পাইকারি থেকে কিনে। দু’বেলা রমরম করে চলত এরশাদ মিঞার ভাত, সব্জি-পরোটা-ডাল-কাবাবের দোকান। পথচলতি মানুষ তো খেতেনই, দামে সস্তা হওয়ার কারণে কাদরপুর বাজারের অন্য দোকানিরাও দিব্যি এসে খেতেন একসঙ্গে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে। তাঁরা বলছিলেন, "সে দিন রাস্তার মোড়ে এসেই শুনছি জয় শ্রীরাম ধ্বনি আর বিরাট ভিড় জমা হয়েছে এরশাদ মিঞার দোকানের সামনে। সব বাইরের লোক, কাউকে চিনি না। অন্তত এই তল্লাটের তো নয়ই। আগুন লাগাতে দেখে আর ওই চিৎকার শুনে ভয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টা পরে এসে দেখি দোকান পুড়ে ছাই। আর উল্টো দিকে যে কম্বলের দোকান দেখেছেন, সেটারও আর কিছু নেই।’’

ফেরার পথে আফরিনের বস্তিতে ওঁর বর মনসুখের সঙ্গে দেখা। মনসুখ একটি বহুতলের ফ্ল্যাটে ড্রাইভারের কাজ করে। গাড়ির মালিক হিন্দু, মনসুখকে বলেছেন, বেতন নিয়ে চিন্তা নেই। আরও এক সপ্তাহ আসতে হবে না। তার পরে অবস্থা বুঝে। বিমর্ষ হয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে মোবাইল ঘাঁটছে মনসুখ। বহুতল আর কাচের মিনারের ছায়ায় চাপা পড়ে থাকা অন্ত্যজ আর এক গুরুগ্রাম, আজ ভাল নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gurugram Haryana
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE