জেলে যাওয়া ‘শাপে বর’ হয়েছিল হেমন্ত সোরেনের। সেই জেলে যাওয়াই ‘কাল’ হল অরবিন্দ কেজরীওয়ালের। ব্যবধান মাত্র আড়াই মাস!
গত নভেম্বরে জেল থেকে ফিরে রাঁচীর কুর্সিতে প্রত্যাবর্তন হয়েছিল হেমন্তের। ঘটনাচক্রে, তখন হেমন্তকাল। কিন্তু দিল্লির ভোটে কেজরীওয়ালের জন্য বসন্ত এল না। হেমন্তকে গ্রেফতার করেছিল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। অভিযোগ ছিল জমি দুর্নীতির। কেজরীকেও গ্রেফতার করেছিল ইডি। অভিযোগ ছিল মদের লাইসেন্স দেওয়ার দুর্নীতির। ভোটের প্রচারে সেই গ্রেফতারিকে হেমন্ত এবং কেজরীওয়াল দু’জনেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’র ভাষ্য হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। ভোটের ফল বলছে, ঝাড়খণ্ডের মানুষ হেমন্তের প্রচার গ্রহণ করলেও কেজরীকে প্রত্যাখ্যান করেছে দিল্লি।
তবে ভোটের অঙ্ক এত সরল নয়। তা নির্ভর করে আরও অনেক সমীকরণের উপর। ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত জোট বেঁধে লড়াই করেছিলেন। সেই জোটে যেমন ছিল লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডি, তেমনই ছিল কংগ্রেসও। অরণ্যের প্রাচুর্য থাকা ঝাড়খণ্ডের খোপে খোপে লালঝান্ডার দল সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর শক্তি রয়েছে। তারাও শামিল হয়েছিল বিজেপি-বিরোধী সেই জোটে। চার দলের মজবুত জোট ঠেকিয়ে দিতে পেরেছিল বিজেপিকে। কিন্তু দিল্লিতে জোট ছিল না। কংগ্রেসের প্রচারে যেমন বিজেপিকে নিশানা ছিল, তেমনই ছিল কেজরীর দলকে আক্রমণও। আবার কেজরীও তাঁর প্রচারে বিজেপি এবং কংগ্রেসকে এক বন্ধনীতে ফেলে বিদ্ধ করেছিলেন। ভোটের অঙ্কে তার প্রতিফলন স্পষ্ট।
আরও পড়ুন:
দিল্লি বিধানসভা ভোটের ফলাফল বলছে, একাধিক আসনে কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটির জন্য আম আদমি পার্টির প্রার্থীরা হেরে গিয়েছেন। সেই তালিকায় রয়েছেন কেজরী স্বয়ং। রয়েছেন মণীশ সিসৌদিয়ার মতো নেতাও। ফলে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’য় থাকা দুই দল আপ এবং কংগ্রেস একসঙ্গে লড়লে কী হত, সেই জল্পনা থেকেই যাচ্ছে। যদিও বিজেপি-বিরোধী একাধিক আঞ্চলিক দল ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছে, লোকসভায় একটু ভাল ফল করতেই কংগ্রেসের পুরনো ‘বিগ ব্রাদার অ্যাটিটিউড’ (দাদাগিরি) বেআব্রু হয়ে যাচ্ছে। যার ‘সুফল’ পাচ্ছে বিজেপি।
গত পাঁচ বছরে নানা কারণে কেজরীওয়ালের দিক থেকে জনসমর্থন যে সরেছে, তা ভোটের ফলে স্পষ্ট। এক ঝটকায় কমে গিয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ ভোট। শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত চূড়ান্ত ফল বা ভোট শতাংশের তথ্য প্রকাশ করেনি জাতীয় নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত যা চিত্র, তাতে স্পষ্ট যে, বিধানসভা ভোটে দিল্লিতে যে ভোটারেরা কেজরীর দলকে ভোট দিতেন, তাঁদের একটা অংশ এ বার বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন।
আরও পড়ুন:
উল্লেখ্য, হেমন্ত প্রথম ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হন ২০১৯ সালে। অন্য দিকে, কেজরীওয়াল ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১৩ সালে। সে দিক থেকে কেজরীওয়ালকে এ বারের ভোটে যেতে হয়েছিল ১২ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা মাথায় নিয়ে। হেমন্তের ক্ষেত্রে সময়টা এত লম্বা ছিল না। আবার এ-ও ঠিক যে, ২৫ বছর বয়সি ঝাড়খণ্ড রাজ্যে হেমন্তই প্রথম, যিনি পর পর দু’বার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ফিরে এসেছেন। সে দিক থেকে পূর্ব ভারতের নবীনতম রাজ্যটিতে শিবু সোরেনের পুত্র ইতিহাসই লিখেছেন।
দুর্নীতির মামলায় জেলে থেকে বা জেল থেকে বেরিয়ে এসে জেতার রেকর্ড যেমন নেতাদের রয়েছে, তেমন হারার রেকর্ডও রয়েছে। বাংলাতেও এমন উদাহরণ রয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। রোজ়ভ্যালি মামলায় জেলে গিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। বেরিয়ে এসে আবার জিতেছেন তিনি। এখন তিনি লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা। আবার ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে জেল থেকে ভোটে লড়েছিলেন তৃণমূলের মদন মিত্র। কিন্তু সে বার কামারহাটিতে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। ২০২১ সালে তাঁর প্রত্যাবর্তন হয়। কিন্তু সুদীপ বা মদন কেউই হেমন্ত বা কেজরীওয়ালের উচ্চতার নেতা নন। কারণ, হেমন্ত এবং কেজরী দু’জনেই মুখ্যমন্ত্রী পদে থেকে জেলে গিয়েছিলেন। তাঁরাই তাঁদের দলের ‘মুখ’।
ঝাড়খণ্ড হেমন্তের ‘মুখ’ রক্ষা করেছিল। দিল্লি করল না কেজরীওয়ালের। ব্যবধান মাত্র আড়াই মাসের!