রাজা ভাগ্যচন্দ্র ধ্রুপদী নৃত্য উৎসবে ওড়িশি নৃত্যশিল্পী সুজাতা মহাপাত্র। মণিপুরের কাংলা দুর্গে।—নিজস্ব চিত্র।
কাংলা দুর্গের কেন্দ্রস্থলে, গোবিন্দ জিউয়ের পুরনো মন্দিরের সামনে, ঝকঝকে বিশাল আঙিনা। মাঝখানে পদ্মপুকুর। পুকুর পাড়ে দু’টি প্রাচীন স্তম্ভ। আর তার সামনে ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে ইট-বাঁধানো দর্শকাসন। এক নজরে দেখলে, সাধারণ চোখে পুরো চত্বরের এই নকলনবিশী ধরে কার সাধ্য? একেবারে চারশো বছর পিছনে গিয়ে সময়টাকে যেন ফ্রেমে বেঁধে ফেলেছেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার চেয়ারপার্সন রতন থৈয়াম। সন্ধ্যার মুখে মুখে জ্বলে উঠল আলো। মন্দিরের প্রেক্ষাপটে, মঞ্চে মায়া ছড়ালেন ওড়িশি, মোহিনীঅট্টম, মণিপুরি নৃত্যের প্রথিতযশা শিল্পীরা। মণিপুরের ইম্ফলে, ঐতিহাসিক কাংলা দুর্গের ভিতরে গোবিন্দজির সংরক্ষিত মন্দির চত্বরে শুরু হল ‘রাজা ভাগ্যচন্দ্র দশম ধ্রুপদী নৃত্য উৎসব’।
সন্ত্রাসদীর্ণ মণিপুর তো কোনার্ক বা খাজুরাহোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। কিন্তু সেখানেই প্রায় একক দায়িত্বে ১৯৮৯ সাল থেকে একটি নৃত্য উৎসবকে বাঁচিয়ে রেখে, তাকে জাতীয় রূপ দেওয়া মুখের কথা নয়। ভাগ্যচন্দ্র নৃত্য উৎসব প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব রতন থৈয়ামের এক স্বপ্নযাপন। রতনের জন্ম নবদ্বীপে। আর এই নবদ্বীপেই মণিপুরের রাজা ভাগ্যচন্দ্রের জীবনের অর্ধেকটা কেটেছে। ‘রাজর্ষি’ ভাগ্যচন্দ্র আজও নবদ্বীপে বন্দিত। তাই নাটকের মানুষ হয়েও, রাসলীলা ও নাট সংকীর্তনের জনক ভাগ্যচন্দ্রের নামে নৃত্য উৎসব করার দায় অনুভব করতেন তিনি। বিস্তর বাধা সত্ত্বেও সে উৎসবকে মরতে দেননি। সেই মমত্ব থেকেই উৎসবের থিমে কাংলা দুর্গকে সাজিয়ে তুলেছেন তিনি।
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) নির্দেশে সংরক্ষিত মন্দির চত্বরে কোনও কাঠামো বা নির্মাণ নিষিদ্ধ। কিন্তু ভাগ্যচন্দ্রের নামাঙ্কিত উৎসব কাংলা ছাড়া কোথায় হবে! সেই কারণেই মন্দিরের পিছনের ঝোপ-জঙ্গল সাফ করে গড়ে তোলা হয়েছে নকল স্তম্ভ, পদ্মপুকুর আর মানানসই টেরাকোটার দর্শকাসন! উৎসব শেষেই যা ভেঙে ফেলা হবে। রতন থৈয়ামের কথায়, “ধ্বংসের কথা মাথায় রেখেই এই সৃষ্টি। প্রথম বার ১৯৮৯ সালে কাঞ্চিপুরে উৎসবের সূচনায় যে মন্দির তৈরি করেছিলাম, তা-ও ভেঙে ফেলা হয়েছিল। এখানে স্থায়ী নির্মাণ সম্ভব নয়। আর জনতার টাকায় উৎসব করছি, তাই বেশি বাড়াবাড়িও ভাল নয়। কিন্তু কোথাও কোনও ফাঁকি রাখা হয়নি। প্লাইউডের থাম বা বাড়ি নয়, সব ইট দিয়ে তৈরি, আগের আমলের মতোই।”
মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্র বৈষ্ণব-পণ্ডিত নরোত্তম ঠাকুরের শিষ্যত্ব নিয়ে জীবনের অর্ধেক সময় নবদ্বীপেই কাটিয়ে দেন। ১৭৭৭ সালে এই ভাগ্যচন্দ্রের হাত ধরেই রাসলীলা নৃত্যের উদ্ভাবন। তার মণিপুরি সংস্করণ ‘নাট সংকীর্তন’ সম্প্রতি ইউনেস্কোর সাস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
গত কাল বিষ্ণুপুর জেলার গোপীনাথ মন্দিরে নাট সংকীর্তন আর মহারাসের মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়েছে। সেখানেও হাজির ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ওক্রাম ইবোবি সিংহ। আজকেও প্রথম থেকেই তিনি দর্শকাসনে। তাঁর কথায়, “২৫ বছর আগে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যে উৎসব শুরু হয়েছিল, তা আজ জাতীয় মর্যাদা পেয়েছে।” কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি বিভাগের অধিকর্তা সাবিত্রীদেবীর ইচ্ছা, তিন বছর অন্তর নয়, এই উৎসব বার্ষিক হয়ে উঠুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy