Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
kailash satyarthi

‘গ্রামে গাভীর দাম দু’লক্ষ, কিন্তু শিশু বিক্রি হয় ১০ হাজারে’

সম্প্রতি কলকাতায় ঘুরে গেলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী। শিশুদের অধিকার রক্ষা থেকে শুরু করে সমাজ-সংস্কৃতি বদলের প্রয়োজনীয়তা-সহ নানা বিষয় উঠে এল তাঁর কথায়। কৈলাশের মুখোমুখি দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।সম্প্রতি কলকাতায় ঘুরে গেলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কৈলাশ সত্যার্থী। শিশুদের অধিকার রক্ষা থেকে শুরু করে সমাজ-সংস্কৃতি বদলের প্রয়োজনীয়তা-সহ নানা বিষয় উঠে এল তাঁর কথায়। কৈলাশের মুখোমুখি দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়।

কৈলাশ সত্যার্থী। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।

কৈলাশ সত্যার্থী। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৮ ১৮:৫৬
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনি দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। এ মুহূর্তে আমাদের দেশে সবচেয়ে অসহায় শিশুরা। একদিকে যেমন শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে, অন্যদিকে বাড়ছে শিশু-পাচার। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা দুনিয়ায় এই রোগ প্রবল।কী বলবেন?
আমাদের এটা গর্ব, আমাদের দেশ চালিত হয় আধ্যাত্মিক, নৈতিক মূল্যবোধের মাধ্যমে। এগুলি আমাদের রক্তে, আমাদের ডিএনএ-র ভেতর রয়েছে। আমাদের সংবিধান, আইন, সমাজ, ইতিহাসে মানবিক বোধের সম্মান অনেক। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুনিয়ার অন্যতম গণতন্ত্রের পিঠস্থান এ দেশে শিশুরা সুরক্ষিত নয়। আমাদের ঘরে, পাড়ায়, স্কুলে, বাসে-ট্রেনে আমাদের শিশুরা সুরক্ষিত নয়।গরিব-বড়লোক নির্বিশেষে শিশুরা সুরক্ষিত নয়।কারণ, শিশুদের সঙ্গে আমরা বন্ধুত্ব বা সম্মানের সম্পর্ক রাখি না।তাদের কাপড়, খাবার, ভাল পড়াশোনার সুযোগ করে দিই, কিন্তু তাদের বন্ধু হই না। বন্ধুত্বের সময় আমাদের নেই। তাদের কথা শোনা বা সেই কথা নিয়ে আলোচনা করার কোনও অভ্যাস আমাদের নেই। তাই শিশুরা মনের কথা মা-বাবার কাছেই বলতে পারে না। বিশেষ করে এই প্রবণতা বেশি মধ্যবর্তী পরিবারগুলোয়।

আজ কোটি কোটি শিশুর এই সমস্যা। তারা ফুটবল খেলতে ভালবাসে, কিন্তু ফুটবল খেলোয়াড় হতে পারে না। আমি এমন শিশুদের সঙ্গেও কাজ করেছি, যারা অন্যের জন্য খেলনা তৈরি করে, কিন্তু নিজেরা খেলনা খেলতে পারে না। আমাদের মেয়েরা জন্তুদের থেকেও কম দামে বিক্রি হয়ে যায়। আমি এমন শিশুদেরকেও মুক্তি দিয়েছি যারা বাংলা থেকে দিল্লিতে বিক্রি হয়ে পাচার হয়েছে। পরিচারিকার কাজ করে তারা। জানিয়েছে, তাদের গ্রামে দু’লক্ষ টাকায় গাভী বিক্রি হয়। কিন্তু তার দাম দশ হাজার। শিশুরা সুরক্ষিত নয়। প্রতি ঘণ্টায় আট জন শিশু চুরি হয়। তারা হাওয়ায় বা আকাশে হারাচ্ছে না।তাদের কেউ না কেউ চুরি করছে, বিক্রি করছে। সে বেশ্যাবৃত্তির জন্যই হোক বা মজুরির জন্য। তাদের শরীরের অঙ্গ দেহাংশ প্রতিস্থাপনেরকাজেও ব্যবহার হয়। প্রতি এক ঘণ্টায় চার জন শিশুর ধর্ষণ হয় এ দেশে।এ কেমন দেশ? যারা এগুলি করছে, তারা শিশুদের মামা-কাকা-দাদা, এমনকী বাবাও।পরিবারের যে ধাঁচা, যা দেশ গঠন করে তা তো ভাঙবেই। যখন বড়দের শিশুরা ভরসা করতে পারে না, তখন কীভাবে আমরা দেশের বুনিয়াদকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব? আমি অনেকবার দেখেছি, শিশুরা বাড়ি ফিরে অগ্রজদের ছোঁয় না। তাদের মনে হয়, সেটা ভাল না খারাপ ছোঁয়া হবে, তারা জানে না। এ সব বললেও বিপদ, না বললেও বিপদ। কত খারাপ আমাদের অবস্থা। তাই বলছি, শিশুদের সুরক্ষিত না করতে পারলে, তাদের দেশের সংস্কৃতি, সংবিধানের মর্যাদা ভেঙে পড়বে। তাই শিশুদের দেশের প্রয়োজনে সুরক্ষা দেওয়া আমাদের প্রাথমিক কাজ।

আরও পড়ুন, ‘একটার অন্তত মরা উচিত’, মুহূর্তে শোনা গেল গুলির শব্দ

প্রশ্ন: আজকের শিশুরা আর মাঠে খেলার সুযোগ পায় না।ভিডিও গেম খেলে। স্বাভাবিক খেলাধুলো, বেড়ে ওঠা ছাড়া শিশুরা আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ছে, হয়ে পড়ছে জেদি ও রাগী।এর সমাধান কোথায়?
শিশুদের মারধর করে কোনও সমাধান হবে না। কারণ, তাতে শিশুরা আরও হিংস্র হয়ে পড়বে। আমরা বড়রা শিশুদের কাছ থেকে তাদের ছোটবেলা কেড়ে নিচ্ছি। আমরা আমাদের স্বপ্ন তাদের উপর চাপাচ্ছি। সব সময় প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া। এটা এক ধরনের নিগ্রহ। অভিভাবক-শিক্ষক, সকলেই সব সময় চাপ দিচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা, ভবিষ্যতের নামে এত চাপ দেওয়া হয়, ভবিষ্যৎ হোক বা না-হোক, বর্তমান তো ঘেঁটে যায়ই।তাই, কালকের জন্য আমরা আজ ছিনিয়ে নিচ্ছি শিশুদের থেকে। পড়াশোনার ধাঁচা, সিলেবাস সব কিছুর বদল দরকার। সবার এই নিয়ে আওয়াজ তোলা জরুরি। শিশুরা এখন মাঠে খেলার বদলে ভিডিও গেম খেলে।মা-বাবা, সমাজ থেকে শিশুরা সরে যাচ্ছে।এলিয়েনেটেড হওয়ায় তারা একা হয়ে পড়ছে। তার থেকেই হতাশা আর ভায়োলেন্স।যখন সবাই মিলে কিছু শেখে, থাকে, তখন মারামারি হলেও আগে এগোনো শেখে মানুষ। কিন্তু যদি আপনি বাড়িতে একা বসে থাকেন, এ তো হবেই।


কলকাতায় কৈলাশ সত্যার্থী।

পাশাপাশি, আমরা শিশুদের সেক্স এডুকেশন দিচ্ছি না। কাজেই, নিজের শরীরকে ব্যবহার করা বা টিনএজারদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যপারে কিছুই তাদের শেখাচ্ছি না। একদিকে ছেলেমেয়েদের মেলামেশায় অবদমিত করছি, অন্যদিকে হাতে ফোন দিয়ে দিয়েছি। তাদের সেই ফোন অফুরান কামনা-বাসনায় নিয়ে যাচ্ছে। এই দুইয়ের দ্বন্দ্বেই শিশুদের মানসিক রোগ দেখা দিচ্ছে। তারা ফোনে অশ্লীল ছবি দেখছে। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, ভারতে ইন্টারনেটের যে সার্ভিস প্রোভাইডাররা রয়েছে, তাদের এটা বলে যাওয়া যে তাদের ডেটা প্রোভাইডেশন ব্যবস্থায় যাতে কোনও পর্নোগ্রাফি না দেখানো হয়। বাবা-মায়ের অন্তত এ সব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। যাকে তাঁরা ভাল বলছেন, তা আদতে খারাপ।

প্রশ্ন: এই বদল তো একদিনে সম্ভব নয়। যে কোনও দেশ তার সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। ছেলেবেলা থেকে কেরিয়ারিস্ট করার ভেতর দিয়ে শিশুরা তো প্রতিযোগী হয়ে যাচ্ছে। কখনওই বন্ধু হচ্ছে না তারা। আপনার এ বিষয়ে কী মনে হয়?
আমি আগেই বললাম, ছেলেবেলা থেকে বন্ধুত্বের সংস্কৃতি থাকা দরকার। তবেই গোটা ব্যক্তিত্ব বদলাতে পারে।বাবা-মাদের বন্ধু হতে হবে। সন্তানদের কথা শুনতে হবে। তাকে চকোলেট খাওয়ানো নয় শুধু। বাচ্চাদের থেকে শিখতে হবে আমাদের। তাদের থেকে শেখা শুরু করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।এই শিশুকে বড় বড় ধর্মগুরুদের সামনে আমি দাঁড় করাতে পারি। জোর দিয়ে বলছি, শিশুদের থেকে সৎ কেউ না।পবিত্রতার নিশান এই শিশু। এই কলকাতায় কোটি কোটি লোক কালীঠাকুরের শক্তিকে পুজো করে। কিন্তু আজ রাতে আপনার বাড়ির লোকেরা কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে চিন্তিত হয়। কারণ, আপনার বাড়ির লোকেরা সুরক্ষিত নয়। কালীকে তাই ডাকি আমাদের ভয় থেকে মুক্ত করতে। এই ভয়ের মধ্যে বেঁচে আমরা কোন ঐতিহ্যের কথা বলব? আমাদের ঐতিহ্য তা হলে তো ভণ্ড। আমরা তার মধ্যেই বেঁচে আছি।আমাদের তাকে বাঁচাতে হলে কলকাতার সমস্ত শিশুকে বাঁচাতে হবে। তবেই সেই সমাজ বদল সম্ভব।

প্রশ্ন: একদিকে আসিফা আর অন্যদিকে সিরিয়া। পাশাপাশি, রোজ খবরের কাগজে, টিভিতে রিগ্রেসিভ খবর। খুব লোকাল এই মাটিতে দাঁড়িয়ে কীভাবে নিজেদের এই রোগ থেকে মুক্ত করতে পারি আমরা?
একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে, আমার মনে হয়, আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। তা থেকেই এক ধরনের মিউচুয়াল ট্রাস্টে পৌঁছতে পারি। ইন্সিকিওর বলেই হয়তো আমরা অবদমন করে থাকি। পাশাপাশি, আমাদের জন্য আমাদের বাসনা-কামনা অনেক বেশি। সেটা পূরণ করা সম্ভব নয়। এই কনজিউমার সংস্কৃতি শুধু মূল্যবোধ ভাঙছে না, ভাঙছে পরিবেশ বাস্তুতন্ত্রকেও। নগরায়ণ, বিশ্বায়ন, যান্ত্রিকীকরণ যা-ই বলুন, সবই কিন্তু রোজ ভেঙে ফেলছে পরিবেশ। বাতাসকেও নষ্ট করছে। তাই বলব, এর একটা রাজনৈতিক দিক রয়েছে, তেমনই রয়েছে আমাদের নিজেদের সংযত করার দিক। আমাদের আরও কমপ্যাশনেট হতে হবে, হতে হবে এমপেথেটিক। তবেই আমরা এই ব্যবস্থার সাথে কানেক্ট করতে পারব। আমাদের রাজনীতি, পরিবার, ধর্ম, এনজিও, মিডিয়া কমপেশন হারিয়েছে। আমি তো আমাদের রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীদেরকেও বলি শিশুদের থেকে শিখতে। এক কথায় আমাদের এভাবেই শেকড়ের দিকে ফিরে যেতে হবে। তবেই সিদ্ধি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kailash satyarthi Syria Asifa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE