‘অপারেশন সিঁদুরের’ পরে প্রায় তিন সপ্তাহ জাতীয় সঙ্কটের আবহে মোদী সরকারের সঙ্গে ঐকমত্য বহাল রেখে গিয়েছিলেন কংগ্রেস-সহ প্রায় সব বিরোধী দলের নেতৃত্ব। কিন্তু এ বার বিরোধীরা ফিরছেন বিরোধিতাতে। রাষ্ট্রপুঞ্জে ইজ়রায়েলের হামলা বন্ধে নিঃশর্ত বিরতি চেয়ে এবং ইজ়রায়েলের তীব্র নিন্দা করে যে প্রস্তাবটি পাশ করা হয়েছে, তাতে শরিক হয়নি ভারত। ঠিক দু’বছর আগে এই প্রস্তাবে একই ভাবে ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে যেতে চায়নি ভারত, ভোটদান থেকে বিরতই থেকেছে।
কিন্তু আজ বিদেশনীতির এই ‘তৈলাধার পাত্র না পাত্রাধার তৈল’ ঘিরে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রিয়ঙ্কা গান্ধী-সহ কংগ্রেসের একাধিক শীর্ষ নেতা দফায় দফায় প্রতিক্রিয়া দিয়ে বিষয়টিকে ঘরোয়া রাজনীতির উঠোনে আনতে চেয়েছেন। সংখ্যালঘু ভোটের দিকে তাকিয়ে(প্যালেস্টাইনের আবেগ) কংগ্রেসের এই আক্রমণ হলেও বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, আসন্ন বিহারের ভোটের ময়দানে তার কোনও প্রভাব পড়বে না। আর জাতীয় রাজনীতিতে যদি প্রভাব পড়েও, তাতে বিজেপির লাভ বই লোকসান নেই। মেরুকরণের যে রাজনীতিকে সামনে রেখে ভোট লড়ছে বিজেপি, তাতে মুসলমান বিরোধিতার অভিযোগ যত বাড়ে, হিন্দু ভোটকে সংহত করা ততটাই সুবিধাজনক হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন ‘অপারেশন সিঁদুরের’ হাওয়া এখনও টাটকা।
রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রস্তাবে ভারতের বিরত থাকার বিষয়টিকে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী শনিবার ‘লজ্জাজনক’ ও ‘হতাশাজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। এক্স হ্যান্ডলে তিনি বলেন, “যেখানে ষাট হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, যার বেশির ভাগই নারী ও শিশু এবং গাজ়াবাসীকে না খাইয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, সেখানে ভারত কোনও অবস্থান না নিয়ে মৌন রয়েছে।” তাঁর অভিযোগ, ভারত শুধু নীরব নয়, বরং ইজ়রায়েলের ইরান আক্রমণ এবং সেখানকার নেতাদের হত্যাকাণ্ডকে কার্যত সমর্থন করছে। প্রিয়ঙ্কার কথায়, “এটি আমাদের সংবিধান এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শের পরিপন্থী। সত্য ও অহিংসার পক্ষে নির্ভীক ভাবে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি। অতীতে ভারত এই সাহস দেখিয়েছে। আজও বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে হলে সেই মানবিক কণ্ঠস্বর ফিরিয়ে আনতে হবে।”
পাশাপাশি, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে বলেন, ‘‘এটা আজ আরও বেশি করে স্পষ্ট যে, আমাদের বিদেশনীতি টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। বিদেশমন্ত্রীর একের পর এক ব্যর্থতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এ বার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি সংলাপ এবং সংঘাতবিরতি নিয়ে আমরা কি আমাদের অবস্থান পরিত্যাগ করেছি?” তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করেন এআইসিসি-র সাধারণ সচিব কে সি বেণুগোপাল।
গাজ়া নিয়ে ভোট না দেওয়াকে ভারত অবশ্য তার ‘নিজস্ব অবস্থানের ধারাবাহিকতা’ হিসাবে তুলে ধরেছে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, ‘আমরা গাজ়ায় আক্রমণকে সমর্থন করিনি। আবার প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও ভোট দেওয়া হয়নি।’ নয়াদিল্লির বক্তব্য, গাজ়ায় মানবিক সমস্যার বিষয়ে ভারত গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। তবে ভারত এই নিয়ে ২০২২ সাল থেকেই কোনও ভোটাভুটিতে অংশ গ্রহণ করেনি। ভারত মনে করে, সংলাপ এবং কূটনীতি ভিন্ন এই সমস্যা সমাধানের কোনও উপায় নেই। শনিবার সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন বা এসসিও-র তরফে ইরানে হামলার বিরুদ্ধে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তার থেকেও নিজেকে দূরে রেখেছে ভারত। ইরানের উপর ইজ়রায়েলি হানার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ৯ দেশের মিলিত মঞ্চ এসসিও। এই মঞ্চের সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ভারত এবং ইরান উভয়েই রয়েছে। এসসিও-র বিবৃতির থেকে দূরত্ব রেখে পৃথক ভাবে বিবৃতি প্রকাশ করেছে নয়াদিল্লি।
বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, এ বিষয়ে ভারত শুক্রবারই নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেছে এবং এখনও সেই অবস্থানেই রয়েছে। আলোচনা এবং কূটনৈতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ইজ়রায়েল এবং ইরানকে সংঘর্ষ থামানো জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। বিদেশ মন্ত্রক আরও জানিয়েছে, শুক্রবারই ইরানের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নয়াদিল্লির এই সামগ্রিক অবস্থানের কথা এসসিও সদস্য রাষ্ট্রগুলিকেও জানানো হয়েছে। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ প্রশ্ন তোলেন, “বিদেশ মন্ত্রকের এই বিবৃতির মানে কী। মনে হচ্ছে যেনইজ়রায়েল ইরানকে আক্রমণ করতে পারে, কিন্তু ইরানকে সংযম দেখাতে হবে! আমরা কি ইজ়রায়েলের হয়ে মিহি গলায় ক্ষমা চাইবার পাত্রে পরিণত হয়েছি?”
কূটনৈতিক সূত্রের মতে, ইজ়রায়েল-বিরোধী কোনও প্রস্তাব মোদী সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চে নেবে না, সে দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ও কৌশলগত নির্ভরতার কারণেই। কৌশলগত নিরাপত্তা, জলসম্পদ, কৃষি, প্রতিরক্ষা—এই সমস্ত ক্ষেত্রেই মোদী সরকারের সঙ্গে গত এগারো বছরে ধারাবাহিক ভাবে সম্পর্কে উন্নতি হয়েছে ইজ়রায়েলের। এটাও ভারতের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় যে ‘অপারেশন সিঁদুরের’ পরে ইজ়রায়েলই সর্বপ্রথম আত্মসুরক্ষার অধিকারের কথা তুলে ভারতে সমর্থন করেছিল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)