মায়ানমারে জঙ্গি অভিযানকে কেন্দ্র করে ভারতের ‘বাগবোমা’কে কেন্দ্র করে বিতর্ক বন্ধ হতেই চাইছে না। আজ এক দিকে যদিও বিজেপির তরফে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা হয়েছে, তখনও মনোহর পার্রিকরের মতো নেতারা বুক বাজানো বন্ধ রাখেননি। অন্য দিকে পাল্টা আক্রমণ শানিয়েছে পাকিস্তানের মুশারফ থেকে শেরি রহমানরা। দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’ ছাতির সশব্দ প্রদর্শন বিজেপিকে হয়তো কিছুটা সুবিধা করে দিতে পারবে। কিন্তু মায়ানমারের জঙ্গলে জঙ্গি অভিযান নিয়ে বিজেপি তথা সরকারের ঢক্কানিনাদ, আন্তর্জাতিক অস্বস্তিকেই পাত পেড়ে ডেকে আনল বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল শিবির।
মণিপুর ও নাগাল্যান্ড ঘেঁষা মায়ানমারের ভূখণ্ডে অভিযান শেষ হতে না হতেই বিষয়টিকে কার্যত রাজনৈতিক প্রচারের মশলা বানিয়ে মাঠে নেমেছেন বিজেপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গডকড়ি, প্রকাশ জাভরেকর, রাজ্যবর্ধন রাঠৌরেরা। বাদ যাননি প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পার্রিকরও। রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, বিষয়টির স্পর্শকাতরতার দিকটি মাথায় না রেখেই এই বুক বাজানোর ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রমশ তাপমাত্রা বেড়েছে। যার উদাহরণ, সকালে মায়ানমার এই অভিযানের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বললেও পরে সরকারি ভাবে তা অস্বীকার করে। সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চিন। পশ্চিম সীমান্ত থেকে পাকিস্তানও নড়ে চড়ে বসে বিষোদ্গার করা শুরু করেছে। কূটনৈতিক শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ঘরোয়া ভাবে জানানো হচ্ছে, এই গোপন অভিযানটির শেষে এমন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ছিল।
বিষয়টি এমন নয় যে দু’টি জঙ্গি ঘাঁটি নিকেশ করে ওই অঞ্চলে ভারত বিরোধী সামগ্রিক সন্ত্রাসবাদকে উৎখাত করে দেওয়া সম্ভব হল। ভারতীয় কর্তারা এ কথা ভাল করেই জানেন যে এটা একটা দীর্ঘমেয়াদী লড়াই। এক ভোররাতের অভিযানে যা সামগ্রিক ভাবে জিতে যাওয়া সম্ভব নয়। এই ধরনের অভিযানের জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটা হল অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নিজেদের রণকৌশল পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত করে যাওয়া এবং কাজ সমাধা হলে তাকে যতটা সম্ভব আড়াল করে রাখা। তার কারণ মূলত দু’টি। চূড়ান্ত গোপনীয় এই অভিযানের ধরনধারণ সম্পর্কে অতিরিক্ত চর্চা করলে পরবর্তী সময়ে সতর্ক হয়ে যেতে পারে জঙ্গিরা। দুই, বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থবহন করা প্রতিবেশী দেশ এবং আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র সংকেত যেতে পারে। বন্ধুভাবাপন্ন নয়, এমন রাষ্ট্রগুলি অবস্থার সুযোগ নিতে পারে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে দক্ষিণ ভুটানে বাজপেয়ী সরকার উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৩০টি ঘাঁটিতে যখন অভিযান চালিয়েছিল, তা নিয়ে টুঁ শব্দটিও করা হয়নি। প্রতিরক্ষামন্ত্রকের পক্ষ থেকে শুধু যেটুকু সাংবাদিক সম্মেলন করার তা করা হয়েছিল মাপা শব্দে। কিন্তু সেই প্রশাসনিক পরিণতিবোধটুকু এ ক্ষেত্রে দেখা দেল না বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
মায়ানমারের জঙ্গল থেকে বারুদের গন্ধ মেলানোর আগেই প্রকাশ জাভরেকর বলে বসলেন, ‘‘সমস্ত জঙ্গি সংগঠনগুলির এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। এটা বোঝা উচিত নিজেদের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে গিয়েও সন্ত্রাসবাদীদের শিক্ষা দিতে দ্বিধাগ্রস্ত নয় ভারত।’’ তিনি যেখানে শেষ করলেন সেখান থেকে শুরু করলেন রাজ্যবর্ধন সিংহ রাঠৌর। তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন, মায়ানমারে যা হয়েছে তা ভারতের পশ্চিম সীমান্তেও ঘটতে পারে! গডকড়ীও সাংবাদিকদের জানালেন মোদী সরকার ‘জিরো টলারেন্স’-এ বিশ্বাসী। ঘটনার পরে পাকিস্তানের তরফ থেকে মন্তব্য করা হলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলে বসলেন, “ভারতের এই নতুন রূপ দেখে যারা ভয় পাচ্ছে, তারাই এই সব মন্তব্য করছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে এই সব ঘটনায় আক্রমণকারী দেশ তথা সরকারকে থাকতে হয় প্রচারের আলোর পিছনে, আপাত অদৃশ্য ভাবে। এটাও হিসাবের মধ্যে রাখা উচিত যে অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের পক্ষে কিছুতেই স্বীকার করা সম্ভব নয় যে তার জমিতে ঢুকে অন্য কোনও দেশ নাশকতা বিরোধী অভিযান করছে। মায়ানমারের সঙ্গে নয়াদিল্লি যে গোপন সমঝোতা করে চলছিল তাতে এমনিতে কোনও সমস্যা ছিল না। এই ঘটনায় মায়ানমার নিজেদের কৌশলগত লাভের হিসাবও কষে রেখেছিল। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মোদী সরকারের রাজনৈতিক ম্যানেজাররা হৈচৈ শুরু করার পর একাদিক্রমে প্রতিক্রিয়া জানায় চিন এবং পাকিস্তান।
চিনের এই প্রতিক্রিয়া মায়ানমারের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই কারণে যে, তাদের সঙ্গে সম্প্রতি নরম-গরম কূটনীতির মধ্যে দিয়ে চলতে হচ্ছে নে পি দাও কে। বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত ভাবে চিনের উপর নির্ভরশীলতাও মায়ানামারের জুন্টা সরকারের যথেষ্ট রয়েছে। এই সব চাপের কারণেই বুধবার রাতে সরকারি ভাবে মায়ানমারের পক্ষ থেকে হাত ধুয়ে ফেলে জানিয়ে দেওয়া হয়, তাদের মাটিতে কোনও অভিযান হয়নি! যা হয়েছে তা সীমান্তের ওপারে ভারতীয় ভূখন্ডে। এত ঢাকঢোল পেটানোর পর তাদের এই প্রতিক্রিয়া সাউথ ব্লককে নিশ্চিত ভাবে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পথটি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই খুলতে চাইছে মোদী সরকার। সীমান্তে জঙ্গি হামলা বা ভারতের ভিতরে কোনও নাশকতা ঘটলে তৎক্ষণাৎ তার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেওয়াটাও সেই আলোচনার প্রক্রিয়ার মধ্যেই পরে। কিন্তু যেভাবে মায়ানমারে গিয়ে দু’টি জঙ্গি ঘাঁটি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেভাবে ইসলামাবাদে যে কিছু করা যাবে না সেটা অজানা নয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের। কিন্তু তা সত্ত্বেও জোর করে মঙ্গলবার ভোরের ঘটনার সঙ্গে ভারতের পশ্চিমসীমান্তের নাশকতা দমনের সংযোগ তৈরি করে পাক বিরোধীতাকেই অকারণে উস্কে দেওয়া হল বলে মনে করা হচ্ছে।