Advertisement
E-Paper

চিনা আগ্রাসনের ইতিহাস শুনিয়েই অরুণাচলের পথে দলাই লামা

ধর্মে ভরসা থাকলেই বদল আসবে না। বদল আনবে শিক্ষা ও সচেতনতা। কোনও সশস্ত্র জঙ্গির সামনে পড়লে তাকে করুণার আদর্শ বোঝাবো না। পালাব। কোনও জঙ্গির নামের আগে ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নাম জোড়া অন্যায়।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০১৭ ১৮:৩০

ধর্মে ভরসা থাকলেই বদল আসবে না। বদল আনবে শিক্ষা ও সচেতনতা।

কোনও সশস্ত্র জঙ্গির সামনে পড়লে তাকে করুণার আদর্শ বোঝাবো না। পালাব।

কোনও জঙ্গির নামের আগে ধর্ম বা সম্প্রদায়ের নাম জোড়া অন্যায়।

এবং, আমি ভারতের দীর্ঘতম অতিথি।

কখনও স্বভাবজ রসিকতা, কখনও ঋজু কণ্ঠে নিজের বিশ্বাস ঘোষণা- প্রথাগত ধর্মগুরুর চেনা ছক ছিঁড়ে ফেলে, ১২ দিনের অসম-অরুণাচল সফর শুরু করলেন দলাই লামা।

চিন যখন নাগাড়ে হুমকি দিচ্ছে, দলাই লামা ফের তাওয়াংয়ে পা রাখলে অশান্তি ঢেকে আনবে ভারত, তখনই চিনা হুমকি উড়িয়ে, চতুর্দশ দলাই লামা ব্রহ্মপু্ত্রের পারে, চিনের তিব্বত আক্রমণ ও তাঁকে আশ্রয় দেওয়া ভারতের মহানুভবতার গল্প শোনালেন। মাত্র দু’বছর বয়সে চতুর্দশ দলাই লামা হিসেবে চিহ্নিত হন লামো ধোন্ডুপ। নতুন নাম হয় তেনজিং গাতসো। তার পর থেকই শুরু সংগ্রাম। শৈশবে সব আবদার, খাবার লোভ, জাগতিক মোহ কাটিয়ে মহান হওয়ার প্রশিক্ষণ। যৌবনে তিব্বতের স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং স্বভূমি ফেলে ভারতে আশ্রয় নেওয়া। তার পর থেকে নাগাড়ে বিদেশে বসেই চিনের ছায়াযুদ্ধ সামলে শান্তি ও বৌদ্ধধর্ম প্রচার। কিন্তু এত লড়াই, এত নাম, নোবেল তাঁর সরলতাকে ক্রমেই বাড়িয়েছে। তাই মঞ্চে কখনও স্মারক আনতে দেরি, বাতি জ্বালানোর দেশলাই খুঁজতে বিলম্বকে নিজেই রসিকতায় ওড়ালেন নোবলজয়ী ধর্মগুরু। মজাও করলেন রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। বই উদ্বোধন করে বাকিদের হাতে নিজেই তুলে নিলেন বই। ভাবটা এমন, যেন তিনি ছাড়া বাকি সকলেই গুরুত্বপূর্ণ।

আরও খবর: নাবালিকা ধর্ষণের সাজা মৃত্যু! বিল আনতে চলেছে মধ্যপ্রদেশ

১৯৫৯ সালের ৩০ মার্চ ভারতে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। তার ৫৮ বছর পূর্ণ হয়েছে ৪৮ ঘণ্টা আগে। দলাই লামা ভাষণ শুরু করেন, সেই ১৯৫৯ সালে ভারতে পা দেওয়ার ছবি হাতে নিয়ে। ১০ মার্চ থেকে ৩০ মার্চের ঘটনাপ্রবাহ, চিনা আক্রমণের কথা তুলে তিনি বলেন, “ভারতে পা দেওয়ার আগে এ দেশের মনোভাব নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে আসা ৭০-৮০ হাজার তিব্বতিকে শোণিতপুরে আশ্রয় দিয়ে ভারত যে বড় মনের পরিচয় দিয়েছে তা বিরল নজির। এখনও অসম-অরুণাচলের কথা ভাবলেই বিহ্বল হয়ে পড়ি।”

তাঁর কথায়, দয়া মানুষেরও আছে, জন্তুদেরও। কিন্তু প্রধান তফাৎ মানুষ সেই দয়া, করুণার বোধ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সেই ক্ষমতা ব্যবহার না করে তুচ্ছ হানাহানির কুফল দেখেছে বিংশ শতক। যুব প্রজন্মকে বোধ জাগ্রত করে একবিংশ শতককে শান্তি ও সচেতনতার শতক করে তুলতে হবে। তিনি বলেন, "পশ্চিমী দেশগুলি জাগতিক উন্নতির শিখরে গেলেও মনের শান্তি নেই। নাশকতা, স্বার্থপরতার বিশ্বে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ও অহিংসার আদর্শই পারে সুখ ফেরাতে।"

ধর্মগুরুদের বাণী বিতরণের রাস্তায় না হেঁটে দলাই লামা বলেন, "ধর্মের ভূমিকা তুচ্ছ। মানুষ নিজে সুখী হলে পরিবার সুখী। পরিবার থেকেই সুখী হবে সমাজ ও দেশ। সন্ন্যাসীদের পরিবারই নেই। তাই গৃহীদেরই শান্তি ও সুখের বার্তা ছড়াতে হবে। নেতা হোক বা ধর্মগুরু- সকলের কথা মেনে নিলে চলবে না। শিখতে হবে প্রশ্ন করা। ওরা-আমরার বিভেদ ঘোচাতে হবে। প্রার্থনা করে লাভ হবে না। দিন বদল আসতে পারে একমাত্র শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে।" তাঁর মতে, বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাই মানুষকে বেশি করে বস্তুগত লাভের হিসেব শেখাচ্ছে। বদলাতে হবে সেই পদ্ধতি। না হলে বু্দ্ধ, যীশু, গাঁধী থেকে দলাই লামা- শান্তির বার্তা দিয়েও কেউই শান্তি আনতে পারবেন না।

ধর্ম নয়, তিনি বারবার বিজ্ঞানের কথা তুলে বলেন, "বিজ্ঞান দেখিয়েছে মনে রাগ, হিংসা বেশি হলে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে। তাই নিজের ভাল চাইলে মানবিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনুন। দয়াশীল হোন। কিন্তু মানুষের স্বভাবই হল, চরম শিক্ষা না পেলে কিছু শিখতে চায় না। সব সমস্যা মানুষেরই তৈরি করা। তার সমাধানও মানুষকেই করতে হবে।"

দর্শকদের প্রশ্ন ছিল, তবে কি কোনও সশস্ত্র জঙ্গি আপনাকে মারতে এলে তাঁকে করুণার আদর্শ বোঝাবেন?

জলদি জবাব, মোটেই না, প্রথমেই চম্পট দেব। কিন্তু যদি ধরা পড়ে যাই ও সুযোগ পাই, তাকে সুপথে ফেরানোর চেষ্টা করব। জঙ্গিরাও সাধারণ মানুষ। কোনও ভাবে তাদের মগজ ধোলাই হয়েছে। আমাদের মতো সে করুণার শিক্ষা পায়নি। কিন্তু মনে রাখতে হবে জঙ্গির কোনও ধর্ম হয় না। তাই কাউকে মুসলিম বা বৌদ্ধ জঙ্গি বলতে নেই। একজন বিপথগামীর জন্য ইসলামের সব উপাসকদের বদনাম করবেন না।

কিন্তু যে সমাজ দখলদারি, অধিকার, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হিংসার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সেই সমাজের বদল কি সম্ভব? দলাই লামার মতে, "মানুষ বদলাচ্ছে। জমি এখন উর্বর। তাই শান্তির বীজ বপন করার এটাই সঠিক সময়। আমি বিশ্বাস রাখি, শান্তিকামীর দল ক্রমশ ভারি হচ্ছে।"

আসাম ট্রিবিউন-এর ৭৫তম বর্ষপূর্তীর অনুষ্ঠানে অংশ নেন দলাই লামা।

আগামী কাল গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় যোগ দেবেন তিনি। আসবেন নমামি ব্রহ্মপুত্র উৎসবেও। ৩ এপ্রিল ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সঙ্গে মত বিনিময় করার পরে তিনি অরুণাচলে যাবেন। সেখানে লুমলার তারা মন্দির, তাওয়াং, দিরাং, বমডিলা হয়ে ইটানগরে তাঁর সফর শেষ হবে।

এ দিকে দলাই লামার অরুণাচল সফর নিয়ে যে ভাবে ‘ফোঁস’ করে উঠেছে চিন, তাকে খুব একটা আমল দিচ্ছে না ভারত। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজুজু আজ ইটানগরে বলেন, “আমরা চিনের অভ্যন্তরীণ কোনও বিষয়ে মাথা গলাতে যাই না। চিনেরও উচিত নয় এই ধরনের কাজ করা।”

দলাই লামা নিজে গুয়াহাটিতে বলেন, "চিনের আপত্তি সাধারণ ও নৈমিত্তিক ব্যাপার। কোনও সমস্যা হবে না।"

ছবি: রাজীবাক্ষ রক্ষিত

Dalai Lama Chinese Pressure Arunachal Pradesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy