Advertisement
E-Paper

প্রত্যাবর্তন: ডান চোখে আঘাতের চিহ্ন, দেশের মাটিতে পা দৃপ্ত অভিনন্দনের

দুপুর থেকেই টিভির পর্দায় ওয়াঘা-অটারী সীমান্তের দিকে চোখ রেখে বসে ছিল গোটা দেশ। এই বুঝি দেখা গেল তাঁকে। 

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০২:২৩
অভিনন্দন বর্তমান। ছবি: পিটিআই।

অভিনন্দন বর্তমান। ছবি: পিটিআই।

দুপুর থেকেই টিভির পর্দায় ওয়াঘা-অটারী সীমান্তের দিকে চোখ রেখে বসে ছিল গোটা দেশ। এই বুঝি দেখা গেল তাঁকে।

বেলা তিনটে... সাড়ে তিনটে... চারটে... ছ’টা... আটটা... ন’টা। নানা সূত্র মারফত এক-একটা সময় জানা যাচ্ছে, আর তা পেরিয়েও যাচ্ছে। পিছোচ্ছে উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের প্রত্যাবর্তন। ধৈর্যের বাঁধ যখন ভাঙতে বসেছে, তখন সীমান্তের গেটের ও-পারে দেখা গেল তাঁকে।

রাত ৯টা ২১। পরনে যুদ্ধবিমানের পাইলটের পোশাক নয়। ট্রাউজার্স, সাদা শার্টের উপরে নতুন ব্লেজার। ধীর পায়ে হেঁটে আসছেন ভারতের মাটির দিকে। সামনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই জওয়ান। ডান চোখে আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু টানটান চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, গত বুধবার থেকেই তিনি পাকিস্তানি সেনার হাতে বন্দি। মুখের রেখা দেখেও বোঝার উপায় নেই, তাঁর যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছিল পাকিস্তান। বিমান ভেঙে পড়ার আগে তাঁকে প্যারাসুটে লাফ দিতে হয়েছিল। একটা মাত্র পিস্তল সম্বল করে নেমে পড়তে হয়েছিল পাকিস্তানের এলাকায়।

সীমান্তে সঙ্গী পাকিস্তানে ভারতের এয়ার অ্যাটাশে গ্রুপ ক্যাপ্টেন জে ডি কুরিয়েন (বাঁ দিকে) ও পাক বিদেশ মন্ত্রকের ডিরেক্টর (ভারত) ফারেহা বুগতি। শুক্রবার রাতে।

অভিনন্দনের পাশে পাক বিদেশ মন্ত্রকের ডিরেক্টর (ভারত) ফারেহা বুগতি এবং পাকিস্তানে ভারতের এয়ার অ্যাটাশে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন জে ডি কুরিয়েন। গেট থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ালেন সবাই। গেট খুলে হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে এগিয়ে এলেন পাক রেঞ্জার্সের এক জওয়ান। পেরোল আরও কয়েকটা মুহূর্ত। তার পর ওই জওয়ান অভিনন্দনকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে।

আরও পড়ুন: মুক্তির আগে অভিনন্দনের নতুন কী বয়ান রেকর্ড করাল পাকিস্তান?

পাক ডেরায় ৫৮ ঘণ্টা, উইং কমান্ডার অভিনন্দনের ডায়েরি

গেটের এ-পারে, ভারতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিএসএফের অফিসারেরা। কমান্ডিং অফিসার হাত মেলালেন অভিনন্দনের সঙ্গে। তাঁর পাশে দাঁড়ানো আর এক অফিসার পিঠে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলেন পাইলটকে। স্যালুট করে ফিরলেন অটারীর দিকে। বন্ধ হয়ে গেল গেট।

দেখে নিন কী ভাবে হস্তান্তর করা হল অভিনন্দনকে?

• রাওয়ালপিন্ডি থেকে বিমানে নিয়ে আসা হয় লাহৌরে।
• লাহৌর থেকে গাড়িতে ওয়াঘা। হস্তান্তরের আগে অভিনন্দনকে দিয়ে বিবৃতি রেকর্ড করানো হয়।
• অভিনন্দনকে দেওয়া হয় ভিসা। ইমিগ্রেশনের পরে কাস্টমসের কাজের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়।
• তাঁর শারীরিক পরীক্ষা হয়।
• উইং কমান্ডারকে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাসের এয়ার অ্যাট‌াশে গ্রুপ ক্যাপ্টেন জে ডি কুরিয়েন ও পাক বিদেশ মন্ত্রকের ডিরেক্টর (ভারত) ফারেহা বুগতি।
• রাত ৯টা ২১ মিনিটে সীমান্তের গেট খোলে। অভ্যর্থনা বিএসএফ-এর।
• বায়ুসেনার গাড়িতে ওয়াঘা-অটারী সীমান্ত থেকে নিয়ে যাওয়া হয় অমৃতসর বিমানবন্দরে।
• বিমানে দিল্লি, তার পরে নিয়ে যাওয়া হয় সেনা হাসপাতালে।

অটারী চেকপোস্টের বাইরে তখন তৈরি বায়ুসেনার কনভয়। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষায় ঈষৎ ক্লান্ত, বৃষ্টি-ভেজা ভিড়টাও নিমেষে চাঙ্গা। বন্দুকধারী কম্যান্ডোর পাইলট নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল কয়েকটা গাড়ি। একটা ইনোভার কাচ ভেতর থেকে আড়াল করা। অনেকে বললেন, ওই গাড়িতে নিশ্চয়ই আছেন অভিনন্দন। ‘নায়ক’-কে দেখতে না-পেলেও ব্যারিকেডের ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কনভয়ের ভিডিয়ো তুলল জনতা। উঠল হর্ষধ্বনি। কনভয় গেল অমৃতসর বিমানবন্দরে। সেখান থেকে দিল্লি পৌঁছলেন অভিনন্দন। যেখানে অপেক্ষায় তাঁর পরিবার। বিমানবন্দর থেকে দিল্লির সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে।
প্রথমে ঠিক ছিল, সূর্যাস্তের আগেই পাকিস্তান অভিনন্দনকে ভারতের হাতে তুলে দেবে। সেই দৃশ্য দেখতে পাকিস্তানের দিকে ওয়াঘা সীমান্তে অপেক্ষায় ছিল সে দেশের জনতা। ভারতের দিকে অটারীতে অবশ্য ভিড় জমছিল ভোর পাঁচটা থেকেই। হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে, গালে তেরঙ্গা এঁকে কেউ ভাঙড়া নাচছিলেন, কেউ গান গাইছিলেন। ঢাক বাজাচ্ছিলেন বৃদ্ধ এক শিখ। কেউ বলছিলেন, “অনুমতি পেলে কাঁধে করে নিয়ে যাব ওঁকে।” অনেকের হাতে অভিনন্দনের ছবি। দিন যত গড়িয়েছে, মানুষ আর গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে অটারীতে।
কিন্তু কখন ফিরবেন অভিনন্দন? দিনভর এই একটা প্রশ্ন ঘিরেই যাবতীয় ধোঁয়াশা আর উৎকণ্ঠা। সরকারি সূত্রের খবর, পাকিস্তানই অভিনন্দনকে হস্তান্তরের সময় দু’বার বদল করে। প্রথমে জানানো হয়, কাগজপত্র তৈরি হয়নি। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বিমানে লাহৌর, তার পর গাড়িতে ওয়াঘার কাছে পাক সেনার একটি ব্যারাকে তাঁকে এনে রাখা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কর্তাদের দাবি, বরাবরের মতোই পাকিস্তান শেষ মুহূর্তে টালবাহানা করছিল। তবে কোনও দর কষাকষির চেষ্টা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে বায়ুসেনার কর্তারা মুখ খুলতে চাননি।
ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার ঠিক আগে অভিনন্দনের একটি ভিডিয়ো-বিবৃতি প্রকাশ করে পাকিস্তান। মিনিট দেড়েকের ওই ভিডিয়ো দেখে নয়াদিল্লির কূটনীতিকরা বলছেন, অভিনন্দনকে চাপ দিয়ে ওই বিবৃতি রেকর্ড করানো হয়েছে। কারণ ভিডিয়োটিতে অন্তত ১৮টি ‘এডিটিং’ রয়েছে। সেখানে অভিনন্দনকে দিয়ে বলানো হয়েছে, তিনি যুদ্ধবিমানের পাইলট হিসেবে ‘টার্গেট’ খুঁজছিলেন। পাকিস্তানি বায়ুসেনা তাঁর বিমানকে নামায়। তাঁর হাতে পিস্তল ছিল।
উরি-র সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে তৈরি ছবির সেনা অফিসারের ধাঁচে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইদানীং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রশ্ন করছেন, ‘হাউ ইজ় দ্য জোশ?’ ওই বিবৃতিতে অভিনন্দনকে বলতে শোনা গিয়েছে, তাঁকে যে সব পাকিস্তানিরা ধরে ফেলেন, তাঁদের জোশ তুঙ্গে ছিল। কিন্তু পাক জওয়ানরা তাঁকে বাঁচান। পাকিস্তানি সেনারও ঢালাও প্রশংসা করেছেন অভিনন্দন। একই সঙ্গে ‘বাড়াবাড়ি’র জন্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কড়া সমালোচনা করেছেন। দিল্লির মতে, জোর করে বলানো না-হলে অভিনন্দনের পক্ষে এই সব মন্তব্য অস্বাভাবিক।
অনেকের সন্দেহ, এই বিবৃতি রেকর্ড করানোর জন্যই হয়তো অভিনন্দনকে ফেরাতে এত দেরি করল পাকিস্তান। কারণ, তাঁকে নিয়ে পাক নৌসেনা-পুলিশের কনভয় ওয়াঘায় পৌঁছেছিল বিকেল সওয়া ৪টেয়। তারও আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনের অফিসারেরা। পাক সেনা সূত্রের যদিও দাবি, ডাক্তারি পরীক্ষা-সহ পদ্ধতিগত বিভিন্ন ধাপ পেরোতেই এতটা সময় লেগেছে।
পাইলটকে অভ্যর্থনা জানাতে দিল্লি থেকে ওয়াঘায় পাঠানো হয়েছিল বায়ুসেনার দুই এয়ার ভাইস মার্শাল, আর জি কে কপূর এবং এস প্রভাকরনকে। কপূর পরে বলেন, ‘‘সমস্ত প্রক্রিয়া মেনে অভিনন্দনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’’ দেশে ফিরে কী বললেন অভিনন্দন? অমৃতসর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার এস ধীলঁ-র কথায়, ‘‘শুধু হাসছিলেন। দেশে ফিরতে পেরে উনি খুশি।’’
অভিনন্দন ফিরলেও নিয়ন্ত্রণরেখার উত্তেজনা অবশ্য কমেনি। শুক্রবারও সংঘর্ষবিরতি ভেঙে গোলাগুলি চালিয়েছে পাকিস্তান। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ও তিন সামরিক বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। আর পাক সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়া কথা বলেছেন আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার সেনাপ্রধান এবং আমেরিকা, ব্রিটেন ও চিনের কূটনীতিকদের সঙ্গে। পাকিস্তানি সেনার দাবি, বাজওয়া জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত আগ্রাসী পদক্ষেপ করলে পাকিস্তানও তার জবাব দেবে।

ছবি: পিটিআই।

India Pakistan Conflict Abhinandan Varthaman India Pakistan IAF Indian Air Force
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy