‘অপারেশন সিঁদুর’ রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই করা হয়েছে। সকালে সাংবাদিক বৈঠকে সরকারের এহেন ভাষ্যকেই সামনে নিয়ে এলেন বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী। তাঁর বক্তব্য, যা করা হয়েছে, ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ অনুযায়ী করা হয়েছে। এই অভিযান ‘মাপা’, ‘নিয়ন্ত্রিত’, ‘দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন’, ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ এবং ‘সংঘাতবর্ধক’ নয়। ‘অপারেশন সিঁদুরে’র লক্ষ্য ছিল, ফের ভারতে হামলা করতে পারে এমন জঙ্গিদের এবং সন্ত্রাস পরিকাঠামো নির্মূল করা।
আজ মিস্রী এ কথাও জানাতে ভোলেননি যে পহেলগাম হামলার দায় নেওয়া টিআরএফ জঙ্গি গোষ্ঠী সম্পর্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের ১২৬৭ নিষিদ্ধ জঙ্গি তালিকা কমিটির কাছে একাধিক বার রিপোর্ট দিয়েছে নয়াদিল্লি। বিদেশসচিবের বক্তব্য, পহেলগাম কাণ্ডের এক পক্ষকাল কেটে যাওয়ার পরেও পাকিস্তান নিজের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসবাদী পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে লক্ষণীয় কোনও পদক্ষেপ করেনি। বরং পাল্টা অভিযোগ তুলেছে। দেশের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে খবর ছিল, পাকিস্তানের মাটির এই সন্ত্রাস-কারখানা থেকে আবারও হামলা হবে। তাই ভারতের বাধ্যবাধকতা ছিল, পহেলগাম কাণ্ডের জবাব দেওয়া এবং আসন্ন হামলা প্রতিহত করা।
রণনৈতিক শিবিরের মতে, আজ সকালে বিশ্বের কূটনৈতিক মহলে এ ভাবেই একাধিক বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছে সাউথ ব্লক। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী-অস্থায়ী ১৪টি রাষ্ট্রকে (পাকিস্তান বাদে) আলাদা ভাবে জানানো হয়েছে। দিল্লির বার্তা, কোনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের জবাব দেওয়া হয়েছে। তা খুবই সংযত ভাবে করা হয়েছে, যাতে পাকিস্তানের সেনা বা সাধারণ মানুষের ক্ষতি না হয়। সর্বোপরি, রাষ্ট্রপুঞ্জের নির্দেশিকার বাইরে গিয়ে কিছু করা হয়নি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহও বলেছেন, “যারা আমাদের নিরপরাধ মানুষকে মেরেছে, শুধুমাত্র তাদেরই মেরেছি।” কূটনৈতিক সূত্রের মতে, কোনও রাষ্ট্রের ভিতরে ঢুকে আক্রমণ করলে রাষ্ট্রপুঞ্জ তো বটেই, ইউরোপ, আমেরিকা, পশ্চিম এশিয়ার শক্তিশালী দেশগুলির কাছে নিজেদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করার দায় রয়েছে ভারতের। দক্ষিণ এশিয়ায় চিনের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠার চেষ্টা করা নয়াদিল্লি শুধুমাত্র পাকিস্তানের কারণে অর্থনীতি, বাণিজ্য, পরিবেশ, প্রযুক্তির মতো বিষয়গুলিতে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির বিষনজরে পড়তে চায় না। আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পাকিস্তানের নেই, কিন্তু ভারতের রয়েছে।
আজ তাই বিক্রম বলেন, “ভারত কেবল নিজের আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করেছে। এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসবাদের পরিকাঠামো, যা পাকিস্তানের মাটিতে নিরাপদে ছায়া বিস্তার করছে। তারই শিকড়ে আঘাত হানা হয়েছে।’’ তিনি জানান, ২৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপুঞ্জ পহেলগাম হামলার তীব্র নিন্দা করে বলেছিল, অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের এই প্রতি-আক্রমণ তারই সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটি শুধুই প্রতিশোধ নয়, বরং ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা। তাঁর কথায়, ‘‘মুম্বই হামলার পর পহেলগামের ঘটনা সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলা। পরিবারের সামনে পুরুষদের মাথায় গুলি করে মারা হয়েছে। কাশ্মীরের উন্নয়নের উপরেই হামলা। টিআরএফ হামলার দায় নিয়েছে। জইশ, লস্কর-ই-তইবা এই ধরনের ছোট সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করে চলেছে। তার বিরুদ্ধেই এই জবাব।’’
আজ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য-সহ অন্যান্য দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমেরিকার বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো, ব্রিটেনের উপদেষ্টা জোনাথান পাওয়েল, সৌদির উপদেষ্টা মুসেদ আল আইবান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির শেখ তাহনুন, জাপানের উপদেষ্টা মাসাতাকা ওকানো, রাশিয়ার সের্গেই সোইগু, চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই, ফরাসি কূটনৈতিক উপদেষ্টা ইমানুয়েল বন-দের জানিয়েছেন অভিযানের বিষয়ে। দিল্লি আসা ইরানের বিদেশমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরগাচ্চির সঙ্গে কাল বৈঠক করবেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
ভারতের প্রত্যাঘাতের কথা শুনে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমে বলেছিলেন, ‘‘এটা লজ্জার।’’ তবে তিনি এ-ও বলেন, “দুই দেশের সঙ্গেই আমার সম্পর্ক ভাল। তাদের চিনি। আমি দেখতে চাই তারা ঝামেলা মিটিয়েছে, সংঘাত থেমেছে।” ট্রাম্প জানান, কোনও সাহায্যের প্রয়োজন হলে তিনি পাশে থাকবেন। রুবিয়োও বলেন, দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে ওয়াশিংটনের চেষ্টা চলবে।
আজ ভারতের সামরিক অভিযানের ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করছে বেজিং। চিনের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক ঘটনাবলি উদ্বেগের। চিন সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করে। ভারত এবং পাকিস্তানের কাছে শান্তি এবং সুস্থিতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। এমন কোনও পদক্ষেপ তারা যেন না করে, যাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়।’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)