দক্ষিণ ভারতের প্রান্তে কেরলের উপকূলে ৩৬টি ছোটবড় দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে লক্ষদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ। তারই এক ধারের ছোট্ট একটি দ্বীপে প্রতিরক্ষার ঘাঁটি গড়তে চলেছে নয়াদিল্লি। ইতিমধ্যে তার তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গিয়েছে। দ্বীপে জারি করা হয়েছে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। বলা হয়েছে, ওই দ্বীপটিকে প্রতিরক্ষা সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হবে।
৩৬টি দ্বীপের মধ্যে লক্ষদ্বীপের মাত্র ১০টি দ্বীপ বাসযোগ্য। তার মধ্যে একেবারে উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের দ্বীপটির নাম বিত্রা। এই দ্বীপকে কেন্দ্র করেই আপাতত এগোচ্ছে নয়াদিল্লির চিন্তাভাবনা। বিত্রায় মোট ১০৫টি পরিবারের বাস। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির রাজস্ব দফতর গত ১১ জুলাই একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, বিত্রায় সামাজিক প্রভাবের মূল্যায়ন (এসআইএ) করা হবে। সমগ্র দ্বীপটিকে প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই দ্বীপের অবস্থান এবং জাতীয় নিরাপত্তায় তার প্রাসঙ্গিকতার কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারি কোনও নীতি বা কার্যক্রমের কতটা প্রভাব সমাজের উপর পড়ছে, তার বিশ্লেষণ হয় এসআইএ-তে। এর মাধ্যমে ওই কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলি চিহ্নিত করা যায় এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা খাতে বিত্রা দ্বীপ হস্তান্তরের ক্ষেত্রেও সেই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।
আরও পড়ুন:
কৌশলগত দিক থেকে লক্ষদ্বীপ বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ। আরব সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজ এই দ্বীপের পাশ দিয়ে যাতায়াত করে। সামুদ্রিক পরিবহণে এখান থেকেই নজরদারি চালানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন নৌ অভিযানের ক্ষেত্রেও লক্ষদ্বীপের গুরুত্ব রয়েছে। এর অদূরে রয়েছে মলদ্বীপ, যা ভারতের প্রতিবেশী স্বতন্ত্র দ্বীপরাষ্ট্র। সম্প্রতি মলদ্বীপের সরকারের সঙ্গে চিনের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অভিযোগ, মলদ্বীপের মাধ্যমে ভারতের দক্ষিণ উপকূলে নজরদারি চালায় বেজিং। ফলে তার বিপরীতে লক্ষদ্বীপকে শক্তিশালী রাখা প্রয়োজন। এ ছাড়া, লক্ষদ্বীপের এই বিত্রা দ্বীপ থেকে আকাশপথে পাকিস্তানের করাচির দূরত্ব হাজার কিলোমিটার (যদিও জলপথে এই দূরত্ব প্রায় দ্বিগুণ)। দূরত্ব বেশি হলেও মাঝে শুধু জল ছাড়া আর কিছু নেই। এই সমস্ত বিবিধ কারণেই আরব সাগরের মাঝে দ্বীপটির অবস্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সেই তাৎপর্য আরও বেড়ে গিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, লক্ষদ্বীপে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়তে পারলে তা ভারতের পক্ষে যথেষ্ট কার্যকরী হবে। আরব সাগরে নজরদারি চালাতে সুবিধা হবে এর ফলে। দেশের পশ্চিম উপকূল আরও সুরক্ষিত হবে। রাজস্ব দফতরের বিজ্ঞপ্তিতেও এই কৌশলগত অবস্থানের কথা বলা হয়েছে।
কেন্দ্রের এই পরিকল্পনা প্রকাশ্যে আসার পর থেকে সেখানে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। পথে নেমে পড়েছে কংগ্রেসও। বিত্রা আদিবাসী অধ্যুষিত দ্বীপ। লক্ষদ্বীপের কংগ্রেস সাংসদ হামদুল্লা সইদ দাবি করেছেন, এলাকার শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য এই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। বিত্রাকে কোনও ভাবেই কেন্দ্রের হাতে তুলে দেওয়া হবে না। তাঁর কথায়, ‘‘সাংসদ হিসাবে আমি বিত্রার নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা বিত্রার মানুষের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। রাজনৈতিক লড়াই এবং আইনি লড়াই।’’ দাবি, বিত্রার বাসিন্দাদের সঙ্গে সরকার কোনও রকম আলোচনা করেনি। কোনও বিকল্পের সন্ধানও করেনি। কৌশলগত অবস্থানের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এবং তা ঘোষণা করেছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না, দাবি কংগ্রেস সাংসদের।
বছর দেড়েক আগে ভারত এবং মলদ্বীপের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেই প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লক্ষদ্বীপ সফরে যান। মলদ্বীপের কয়েক জন মন্ত্রীর বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ভারতীয় পর্যটকেরা ওই দ্বীপরাষ্ট্র বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। সেই সময়ে বিকল্প পর্যটনস্থল হিসাবে লক্ষদ্বীপের প্রচার এবং জনপ্রিয়তা অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। তখন থেকেই লক্ষদ্বীপের কৌশলগত অবস্থান খবরের শিরোনামে। সম্প্রতি পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে ভারত এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। দুই দেশ সশস্ত্র সংঘাতেও জড়িয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে সমুদ্রঘেরা পশ্চিম সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধির প্রয়োজন আরও তীব্র হয়েছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের একাংশের। সেই কারণেই লক্ষদ্বীপের কিনারায় প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলার তোড়জোড়।