Advertisement
০৪ মে ২০২৪

তারারা শুধু আকাশে জন্মায়? বামেদের মরা গাঙে জোয়ার কানহাইয়া

তারারা শুধু আকাশে জন্মায়? কে বলে! কারাগারও তো গর্ভে ধরতে পারে! নইলে কাল সন্ধ্যায় তিহাড় জেল থেকে যে যুবক বেরিয়ে এলেন, তারার তুলনায় তিনি কম কীসে! এ যেন বিস্ময় বিবর্তন। মাত্র কুড়ি দিন আগে দোহারা চেহারার এক যুবককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠোন থেকে হিড়হিড় করে টেনে তোলা হল পুলিশ ভ্যানে। বলা হল, ও দেশদ্রোহী!

শুক্রবার জেএনইউ চত্বরে সাংবাদিক বৈঠকে কানহাইয়া।

শুক্রবার জেএনইউ চত্বরে সাংবাদিক বৈঠকে কানহাইয়া।

শঙ্খদীপ দাস
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৭
Share: Save:

তারারা শুধু আকাশে জন্মায়? কে বলে! কারাগারও তো গর্ভে ধরতে পারে! নইলে কাল সন্ধ্যায় তিহাড় জেল থেকে যে যুবক বেরিয়ে এলেন, তারার তুলনায় তিনি কম কীসে!

এ যেন বিস্ময় বিবর্তন। মাত্র কুড়ি দিন আগে দোহারা চেহারার এক যুবককে বিশ্ববিদ্যালয়ের উঠোন থেকে হিড়হিড় করে টেনে তোলা হল পুলিশ ভ্যানে। বলা হল, ও দেশদ্রোহী! তার পর আদালত চত্বরে পুলিশের ফসকা বাঁধন গলে বেধড়ক চড়-থাপ্পড় মারা হল তাঁকে। পেটে সটান লাথি পর্যন্ত চালিয়ে দিলেন বিজেপির বীরপুঙ্গব বিধায়ক। অথচ সেই ছেলেই কিনা হপ্তা তিনেক কলাইয়ের থালায় জেলের ডাল-রুটি খেয়ে বেরিয়ে এলেন আগুনপাখি হয়ে! পুরোদস্তুর এক নেতা! কানহাইয়া কুমার! মধ্যরাতে যাঁর কথা শুনে বিদ্যুৎ খেলে গেল তস্য অভিজাতেরও সুষুম্নাকাণ্ড বেয়ে! যাঁর তীক্ষ্ণ বক্তৃতায় অনাহার, জাতিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই একঘেয়ে স্লোগান ছেড়ে চকিতে নতুন মন্ত্র আউড়ে নিল, ‘আজাদি’। আর তা দেখে কেউ বা বলে ফেললেন, আরে ‘এ ছেলে তো ছেলে নয়, দেবতা নিশ্চয়!’ কারও বা রাতের ঘুম চলে গেল। তারিফে (এবং গায়ে জ্বালা ধরলে গালিতে) ভাসিয়ে দিতে কেউ বা রাত ভোর করে দিলেন সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায়।

কিন্তু কে এই কানহাইয়া? তাঁকে রাতারাতি নেতা বানিয়ে দিল কে? সংসদের বারান্দায় কান পাতলে প্রায় সমস্বরে একটাই জবাব এসেছে, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। বিরোধীরা তো বটেই খোদ শাসক দলের মধ্যেও গুঞ্জন তাই। বিহারের এক বিজেপি সাংসদের টিপ্পনি, ‘‘ওঁর সমতুল কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীকে বুঝি মিস করছিলেন মোদী। নইলে এ তো বাঁশ কেটে এনে মঞ্চ বানিয়ে দেওয়া!’’ সাদামাঠা একটা ছেলে। বেগুসরাইয়ে বাপ-ঠাকুরদা চাষবাষ করেই পেট চালিয়েছে। বাড়ির ছোট ছেলে নিজের উৎসাহে গবেষণা করতে এসেছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি, বামপন্থী ঘরানায় বেড়ে ওঠা। রোহিত ভেমুলার মৃত্যুতে আন্দোলনে নেমেছে বলে তাঁকে তখুনি দমন করতে হবে? সরকার লাঠি নিয়ে ঢুকে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে! তার পর সঙ্ঘ পরিবারের কেতায় মাথা মোড়াতে নেমে পড়তে হবে ছাত্রদের! এ বার ঠ্যালা বোঝ! গুঞ্জন কেন্দ্রের শাসক দলেই। বস্তুত বিজেপি যে ঠ্যালা বুঝতে শুরু করে দিয়েছে তা আজ মোদী মন্ত্রিসভার নেতাদের কথাতেও ধরা পড়েছে। বেঙ্কাইয়া নায়ডু সাত সকালেই বলেন, ‘‘একটা ছেলে ফাঁকতালে প্রচার পেয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি করতে হলে পড়াশুনা ছেড়ে দিক।’’

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বিজেপির ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক! কেননা এ ছেলের হাতে মোদীর বিপদ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে এমন চৌখস কথা গত চব্বিশ মাসে কেউ বলতে পারেননি। প্রকারান্তরে সেটা রাহুল গাঁধী, সীতারাম ইয়েচুরি-সহ তামাম বিরোধী নেতৃত্বেরই ব্যর্থতা। তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন বলেই কানহাইয়ার কথা এত মনে ধরেছে মানুষের। এক দিকে তাঁর হেঁয়ালি ভরা কথায় হেসে খান খান হয়ে গিয়েছেন জেএনইউ-তে তাঁর সতীর্থরা। আবার সেই কথার রাজনৈতিক ভার কয়েক মন। কেননা জামিনে মুক্তি দেওয়ার সময় যে ছেলেকে পই পই করে সংযত থাকার নির্দেশ দিচ্ছে আদালত, দম না-থাকলে তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব নয়, ‘‘জবতক জেল মে চানা রহেগা/আনাজানা লাগা রহেগা।’’ দম না-থাকলে মোদী-অমিত শাহকে চ্যালেঞ্জ ঠুকে এ-ও বলা সম্ভব নয় যে, ‘‘আমরা ভারতীয়রা সব ভুলে যাই ঠিকই। কিন্তু এ বারের তামাশা এমনই যে, ভোলা সম্ভব নয়।’’ সরাসরি সঙ্ঘ পরিবারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে এটাও বলা সম্ভব নয় যে, ‘‘ওদের মানসিকতাটাই হলো বিভেদ ঘটানোর। তার থেকে আজাদি চাই।’’ তবে রাজনীতিকদের মতে, বিজেপির ভয়ের কারণটা আসলে অন্য। গত লোকসভা ভোটে নতুন প্রজন্ম মোদীতে মজেছিল। সঙ্ঘ পরিবারের এখন ভয়, কানহাইয়া বুঝি এ বার সেই নতুন প্রজন্মকেই ভাঙিয়ে নেবেন।

রাজনীতিতে এমন আন্দোলনের জন্ম অবশ্য এই নতুন নয়। ইন্দিরা গাঁধী জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন বলেই জনসঙ্ঘের বাড়বাড়ন্ত হয়েছিল। রাজনীতিকদের মতে, আসলে পরিস্থিতিই নেতার জন্ম দেয়, আন্দোলন মাথা তোলে। ঠিক যে কারণে, বিহারে এ বার নীতীশ কুমার লালু প্রসাদের মতো দুই যুযুধান প্রতিপক্ষের জোট হয়েছে, যে কারণে বাংলায় তৃণমূলকে পরাস্ত করতে বাম-কংগ্রেস হাত মিলিয়েছে, সে ভাবেই দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতার পরিবেশে নতুন নেতার উত্থান অনিবার্য ছিল। আজ মনে হচ্ছে, সেই নেতাই হয়ে উঠতে চলেছেন কানহাইয়া।

কানহাইয়ার বক্তৃতার ময়নাতদন্ত এখানেই থেমে থাকেনি। সংসদের সেন্ট্রাল হলে খুশি খুশি চেহারার বাম নেতাদের দেখে আজ দিব্য ঠাওর করা গিয়েছে, মোদীর এলেম আছে। মৃতের দেহেও প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন তিনি। তাঁর দৌলতেই কানহাইয়ার হাত ধরে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগের প্রায় অর্ধ শতক পরে যেন নবজন্ম হল প্রায় অস্তিত্ব খোয়াতে বসা সিপিআইয়ের। এমনকী লুপ্তপ্রায় ‘লাল সেলাম’ স্লোগানেও যেন নতুন আবেগের পরত পড়ল কানহাইয়ার হাত ধরে!

কিন্তু এত তারিফের পর কানহাইয়া কী বললেন? জেএনইউ চত্বরেই আজ সাংবাদিক বৈঠকে করেন তিনি। বললেন, ‘‘ধুর, আমি তারা নই। নেতা হতেও চাই না। আমি ছাত্র। ছাত্রদের ছোট ছোট সমস্যা সমাধানের মধ্যেই থাকতে চাই।’’

যা শুনে আর্দ্র চোখে এক বামপন্থী নেতার মন্তব্য, ‘‘ঠিক পথে চলছেন কানহাইয়া। এখনই তথাকথিত রাজনীতিতে পা বাড়ালে ওঁর কথাগুলো লঘু হয়ে যাবে। তা হতে দেওয়া যাবে না। নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে নৈতিক লড়াইয়ের স্থানটা নিতে হবে ওঁকে। ওঁর দায়িত্ব এখন অনেক বেশি।’’

ছবি: পিটিআই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

new hero kanhaiya kumar left MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE