দেশদ্রোহী অভিযোগে গ্রেফতার জেএনইউয়ের ছাত্র সংসদের নেতা কানহাইয়া কুমারকে ছয় মাসের জন্য শর্তসাপেক্ষে অন্তর্বর্তী জামিন দিল দিল্লি হাইকোর্ট। দিল্লি হাইকোর্ট আজ কানাইয়াকে দশ হাজার টাকার জামানত ভরতেও নির্দেশ দিয়েছে। আর জামিনদার হতে বলা হয়েছে জেএনইউয়ের কোনও একজন শিক্ষককেই।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি সংসদ হামলায় দোষী আফজল গুরুর সমর্থনে জেএনইউতে একটি সভা করার অভিযোগ ওঠে কানাইয়া কুমার, উমর খালেদ, অর্নিবাণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ছাত্র নেতাদের বিরুদ্ধে। সেই অপরাধে গত ১২ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয় কানহাইয়াকে। এরই মধ্যে দু’বার আদালতে পেশ করার সময়ে হামলা চালানো হয় কানহাইয়ার উপরে। কী ভাবে কানহাইয়াকে উপরে নিশানা করে হামলা চালানো হয়েছিল, ছাত্র নেতার সেই বয়ানের ভিডিও সামনে এলে তা নিয়েও কম হয়নি। এরই মধ্যে গত সোমবারই জামিন প্রশ্নে ওই মামলার সওয়াল-জবাব শেষ হয়। আজ ছিল আদালতের চূড়ান্ত রায়দানের পালা।
আজ সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ এই মামলায় রায় দেয় আদালত। দু’পক্ষের সংক্ষিপ্ত সওয়াল-জবাবের পরে বিচারক প্রতিভা রানি কানহাইয়ার ছয় মাসের জন্য অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করেন। তবে শর্তসাপেক্ষে। আদালত জানিয়েছে, এই সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য কোথাও প্রকাশ্য সভায় অংশ নিতে পারবেন না। দেশবিরোধী কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না। কানহাইয়াকে আদালত পুলিশকে সব ধরনের সাহায্য করার পরামর্শ দিয়েছে।
কানাইয়ার মুক্তি সময়ের অপেক্ষা ছিল বলে আজ দাবি করেছেন সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাট। আসলে দিন দুয়েক আগে ওই মামলার শুনানিতে, যে দেশদ্রোহী ধারায় (১২৪ এ) দিল্লি পুলিশ কানহাইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল, সেই ধারাটি সম্পর্কে দিল্লি পুলিশের ভাল ভাবে জানা আছে কিনা তা জানতে চায় দিল্লি হাইকোর্ট। আদালতের ওই প্রশ্ন সামনে আসার পরেই কানহাইয়া শিবিরের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল, ওই ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে যে ভাবে দেশদ্রোহী কাজের অভিযোগ পুলিশ এনেছে তাতে আদৌও সন্তুষ্ট নয় আদালত।
এর মধ্যে দু’পক্ষের শুনানিতে নাকচ হয়ে যায় কানহাইয়ার বিরুদ্ধে পুলিশের আনা সাতটির মধ্যে পাঁচটি ভিডিও। পুলিশের দাবি ছিল, ওই ভিডিওগুলিতে কানহাইয়াকে দেশবিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছে। যার ভিত্তিতেই মূলত ওই ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে পুলিশ। কিন্তু পরে ফরেন্সিক পরীক্ষায় দেখা যায় এর মধ্যে পাঁচটি ভিডিওতে কানাইয়ার মুখে দেশবিরোধী শব্দ ও স্লোগান পরে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পিত ওই পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল কানাইয়াকে দেশদ্রোহী হিসাবে প্রমাণ করা। কিন্তু ফরেনসিক পরীক্ষায় ভিডিওগুলি জাল প্রমাণিত হওয়ায় ওই প্রমাণ বাতিল করে জামিনের নির্দেশ দেয় আদালত।
এ দিকে আজ রাত পর্যন্ত কানহাইয়া প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য করেনি দিল্লি পুলিশ। তবে আদালত শর্তসাপেক্ষ জামিন হওয়ায় এই নির্দেশ তাদের কাছে ধাক্কা নয় বলে দাবি করেছেন দিল্লি পুলিশের আইনজীবীরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘কানাইয়া যদি শর্তাধীন জামিন না পেত সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য ধাক্কা হত। এখন শর্তসাপেক্ষ জামিন পাওযার অর্থ মামলায় সারবত্তা রয়েছে বলেই মনে করছে আদালত।’’ আর পুলিশের পক্ষ থেকে জাল ভিডিও পেশ করার বিষয়ে আইনজীবীদের সাফাই, ‘‘ক্যামেরার সীমাবদ্ধতা থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে সাক্ষী রয়েছে, যারা পুলিশের দাবিকে প্রমাণ করবে।’’ এই আবেদনের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ সুপ্রিম কোর্টে যাবে কিনা তা এখনই স্পষ্ট করতে চাননি দিল্লি পুলিশের আইনজীবী শৈলেন্দ্র কুমার। তিনি কেবল বলেন, ‘‘মামলার সম্পূর্ণ রায় হাতে পেলে তারপর ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’
গত ক’দিনের ঘটনা পরম্পরা কানহাইয়ার পক্ষে যাওয়ায় আজ সকালই থেকেই ওই ছাত্র নেতার মুক্তির দাবিতে প্রহর গুনছিল জেএনইউ। তারই মধ্যে গতকাল সংসদে সরকার স্বীকার করে নেয়, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ (এ) ধারাটি খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আইন কমিশনকে। যদিও তার সঙ্গে এই মামলার কোনও সম্পর্ক নেই বলেই দাবি করে কেন্দ্র। আজ দুপুরে কানাইয়ার মুক্তি ও কেন্দ্রের দমন নীতির বিরুদ্ধে দিল্লির মাণ্ডি হাউস থেকে মিছিল বার করে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা। কানহাইয়াকে মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হয়েছে বলে লোকসভায় সরব হন রাহুল গাঁধীও। এ দিকে কাল সংসদে মোদীর মুখ খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। তার আগে কানহাইয়ার মুক্তি সরকারকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিল বলেই মনে করছে বিজেপির অন্দরমহল। কারণ দলের কেউ কেউ মনে করেন, কানহাইয়ার বিরুদ্ধে সেই অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও বাড়াবাড়ি করেছে দিল্লি পুলিশ। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দলকে। উঠতে-বসতে সংসদে কথা শুনতে হচ্ছে দলকে। কানহাইয়া ছাড়া পাওযায় বিষয়টি থিতিয়ে যাবেই বলে আশা করছে বিজেপির একাংশ। যদিও এই রায়ের পরে সরকারি ভাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানিয়েছেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ নিয়ে মুখ খুলব না।’’
এ দিকে সন্ধ্যায় কানহাইয়ার মুক্তির খবর আসতেই বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে উৎসবে মেতে ওঠেন জেএনইউয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। বাম ঘেঁষা ছাত্র সংগঠন আইসার প্রতিনিধি সুচেতাই বা কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন এনএসইউআইয়ের সানি সকলেরই মতে, ‘‘এ হল গণতন্ত্রের জয়। ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জয়। আদালত ন্যায় বিচার করেছে।’’ খুশি বেগুসরাইতে কানহাইয়ার মা মীনা দেবীও। তিনি বলেন, ‘‘কিছুটা হলেও শান্তি হল। তবে আগে আরও লড়াই বাকি রয়েছে।’’