Advertisement
E-Paper

যাত্রাই নৈবেদ্য কাশীর বাঙালিটোলায়

মোক্ষম ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়! কাশীর দুর্গাপুজোর ক্লাইম্যাক্স সত্যিই বিসর্জনে। তবে কাশীর বাঙালিটোলায় প্রতি বছর পুজোর নাটকটা জমতে শুরু করে বোধনের আগে রথের সময় থেকেই। ধম্মের ষাঁড়, ঘাটের সিঁড়ি আর সন্ন্যাসী— এই নিয়ে যদি কাশীর ষোলো কলা পূর্ণ হয়, তবে কাশীর বাঙালির পুজোতেও যাত্রাপালা প্রায় নৈবেদ্যরই অংশ।

বরুণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:৪২
বাঙালিটোলার পুজোয় যাত্রা। —ফাইল চিত্র

বাঙালিটোলার পুজোয় যাত্রা। —ফাইল চিত্র

মোক্ষম ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়! কাশীর দুর্গাপুজোর ক্লাইম্যাক্স সত্যিই বিসর্জনে।

তবে কাশীর বাঙালিটোলায় প্রতি বছর পুজোর নাটকটা জমতে শুরু করে বোধনের আগে রথের সময় থেকেই। ধম্মের ষাঁড়, ঘাটের সিঁড়ি আর সন্ন্যাসী— এই নিয়ে যদি কাশীর ষোলো কলা পূর্ণ হয়, তবে কাশীর বাঙালির পুজোতেও যাত্রাপালা প্রায় নৈবেদ্যরই অংশ। সে সাবেক বারাণসী দুর্গোৎসব সম্মিলনী হোক বা কাশী দুর্গোৎসব সমিতি— যাত্রাপালা যদি না আসে, উৎসব ফিকে।

প্রতিমা তৈরি করার জন্য আগে যেতেন কুমোরটুলির গণেশ পাল। এখন তাঁর ছেলে মনোরঞ্জন বেনারসে থেকেই একাধিক বারোয়ারি প্রতিমা বানান। সকলেরই নানা রকম খাস আবদার থাকে। কে না চায় পাশের পুজোকে ছাড়িয়ে যেতে! কাশীর তৎকালীন বঙ্গসমাজে শারদোৎসবের উদ্যোক্তাদের সেরার লড়াই বাধত কে কেমন পালা আনতে পারছে, তা নিয়েই। সমকালীনরাও অগ্রজদের এই রীতি মেনে চলেছেন।

পালা বায়না করার দুরূহ দায়িত্বটা বারোয়ারির বাঙালি উদ্যোক্তারা দেন সবচেয়ে চৌখস কর্মকর্তাটিকে। রথ থেকেই শুরু চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায় বায়না করার কাজ। সেরা কাস্টিং, সেরা কনসার্ট, সেরা কসটিউম— এ সবে যেন কোনও আপোস না হয়! ইদানীং সর্বত্র ‘এক্সট্রা’র ব্যবস্থা থাকে। যাত্রাদলেও আছে। সেরা নটনটীদের কেউ দূরে যেতে গাঁইগুঁই করলে তখন ওই ‘এক্সট্রা’র দল থেকেই কেউ না কেউ সামলে দেন।

বাঙালিটোলার প্রৌঢ় উদ্যোক্তারা এ সব ছেলেছোকরাদের হাতে ছাড়তে চান না, তাই নিজেরাই আসেন কলকাতায়। জ্যোৎস্না দত্ত, গুরুদাস ধাড়া, দ্বিজু ভাওয়াল থেকে আজকের তপোবন অপেরার দুলাল চট্টোপাধ্যায় — কার না পালা হয়েছে কাশীর বাঙালিটোলায়। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে একটা চোরা আক্ষেপ মাঝে-মাঝে মুখ ফসকে করেও ফেলেন এই যাত্রারসিকেরা— সত্যজিৎবাবু কেন যে যাত্রাটা বাদ দিলেন!

প্রায় একশো বছর আগে বেনারসের জঙ্গমবাড়ি থেকে ‘কাশীর কিঞ্চিৎ’ নামে একটি বিচিত্র ছড়ার বই প্রকাশিত হয়েছিল। শ্রীনন্দী শর্মা ছদ্মনামধারী লেখক দাবি করেছিলেন, এটি নাকি বিশেষ ভাবে বাঙালির জন্য বিরচিত গাইড বুক। বহু কিস্সা সমন্বিত এই বইটিতে রসিক লেখক সরস ভঙ্গিতে জানিয়ে গিয়েছেন অভিনয়লীলা কাশীর বাঙালির কেমন মজ্জাগত : ‘মাঝে মাঝে দেন তাঁরা নানা অভিনয়/ মোটের উপর বোলতে গেলে কেহ মন্দ নয়/ টিকিট কোরে কভু তাঁরা দর্শনীও নেন/ শুভকার্য্যে সাহায্যার্থে বেনিফিটও দেন।’

সংখ্যায় কমে এলেও কাশীর এই বাঙালিরা এখনও আছেন। সাবেক যাত্রাশিল্প ছাড়া তাঁদের মন ভরে না। ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠী— অর্থাৎ দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত যাত্রাপালার মরসুম— এই প্রবাদের সত্যতা কাশীর বাঙালিরা যথার্থই জানেন। ‘প্রতিপদ আরব্ধ করি যাবৎ একাদশী/ রামলীলা যাত্রা করে যত কাশীবাসী’— সেই দু’শো বছর আগে পদ্যে লেখা ‘কাশী পরিক্রমা’য় বলে গিয়েছিলেন ভূকৈলাসের রাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল। বহু কিংবদন্তী এখনও ভেসে বেড়ায় এই প্রাক পৌরাণিক জনপদে— এই ‘রামলীলা’ নাকি শুরু করেছিলেন তুলসীদাস স্বয়ং, অন্তত কিংবদন্তী তাই বলে।

আজকের পাকা-চুল উদ্যোক্তারা বছর পঞ্চাশ আগে নিজেরাই নাটক করতেন। কিন্তু পাড়াপড়শি, এমনকী অন্দরমহল থেকেও চাপ আসত যাত্রা আনানোর। ‘তোমাদের নাটক তো প্রতি বছর দেখছি বাপু, বছরে এক বার না হয় যাত্রা দেখে আড় ভাঙি’— এমনতরো নানা অনুযোগ। যাকে বলে একেবারে খাস নৃত্যনাট্য, তাও নিয়ে যেতে বাকি রাখেননি উদ্যোক্তারা। স্বয়ং সন্তোষ সেনগুপ্ত মশাই পর্যন্ত গিয়েছেন তাঁর শিষ্যশিষ্যা নিয়ে। কিন্তু যাত্রার বাদ্যির বদলে কোনও কিছুতেই কাশীবাসীর মন সাড়া দেয়নি।

এ বছর নিয়ে টানা চার বার কাশী দুর্গোৎসব সমিতির আসর জমাতে চলেছে চিৎপুরের তপোবন অপেরা। প্রবীণ কর্মকর্তা, গৌরীপুর রাজবাড়ির দীপককান্তি চক্রবর্তী ওরফে গোরাবাবু যাত্র্রার প্রসঙ্গ উঠলেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন, উত্তেজিত হয়ে ওঠেন শিশুর মতো। বলে চলেন, ‘বারবধূ’ নাটকের জন্য সমালোচনায় বিদ্ধ কেতকী দত্ত কেমন সাদরে গৃহীত হয়েছিলেন কাশীধামের দুর্গোৎসবে। ‘মীরাবাঈ’, ‘লালন ফকির’ আর ‘সতীদাহ’— টানা তিন দিন এই তিন পালায় দর্শকের চোখ ভিজিয়ে যোগ্য জবাব দিয়ে গিয়েছিলেন নিন্দুকদের। আবার ‘স্পার্টাকাস’ আর ‘কার্ল মার্কস’ পালা নিয়ে দুর্গামণ্ডপ মাতিয়ে দিয়েছিলেন শান্তিগোপাল— পর্যাপ্ত ভক্তিরস নেই বলে সেই অভিনয় দেখে কাশীর বাঙালিরা গোসা করেননি।

আসলে কাশী যে এক চিরকালীন মিলনমেলা— তা শারদীয়া যাত্রার আসরে এখনও বেশ বোঝা যায়। শারদীয়া তীর্থযাত্রী আর যাত্রার দর্শক মিলেমিশে যায় এখনও।

puja jatra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy