কী ভেবে এসেছিলেন। আর কী প্যাঁচেই না পড়লেন।
ভেবেছিলেন পূর্ণিমার রাতে লাদাখের প্যানগং লেক দেখে চোখ জুড়োবেন। তার বদলে সেনা অফিসারদের চোখ রাঙানি দেখতে দেখতে রাত কাটাতে হচ্ছে ক্যাম্পে। সেখানে হোটেলের সুবিধে-স্বাচ্ছন্দ্য তো দূরের কথা, মোবাইল থেকে ফোন করার ‘অধিকার’টুকুও নেই।
এখন এমনই অবস্থা কাশ্মীরে আটকে পড়া বাঙালি পর্যটকদের। কেউ গিয়েছিলেন প্রকৃতির টানে, আবার কেউ বা অমরনাথ তীর্থযাত্রায়। ইচ্ছে-স্বপ্ন আপাতত সব উড়ে গিয়েছে। এখন একটাই চিন্তা— কবে, কী ভাবে বাড়ি ফিরবেন। কাশ্মীরে সাম্প্রতিক গণ্ডগোলের জেরে অমরনাথ যাত্রা আপাতত স্থগিত হয়ে যাওয়ায় খুবই মুশকিলে পড়ে গিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ-সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের পূণ্যার্থীরা।
দিন কয়েক আগে কলকাতা, হাওড়া ও হুগলির বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩২ জনের একটি দল দিল্লি হয়ে শ্রীনগর যাবে বলে যাত্রা শুরু করে। দলে সাতটি বাচ্চাও রয়েছে। শ্রীনগর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে দলটিকে আটকে দেয় সেনা। কারণ একটু দূরেই তখন সিআরপিএফের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ চলছে। বাঙালি পর্যটকের দলটির ঠাঁই হয় মীরবাজার এলাকার এফসিআই (ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া)-এর গুদামে। চোখের সামনে গুলি, কাঁদানে গ্যাস আর টানা ইট বৃষ্টি দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে যান দলের সকলেই। শুধু এই রাজ্যের দলটি নয়, কয়েক হাজার অমরনাথ-পূণ্যার্থী ও পর্যটকের অস্থায়ী আস্তানা হয়েছে এই ক্যাম্প।
ওই দলেই রয়েছেন পর্যটক সুব্রত সরকার। তিনি বললেন, ‘‘এখানে আমরা অন্তত তিন হাজার লোক আটকে রয়েছি। ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি সকলে।’’ সুব্রতবাবুই জানালেন, তীর্থযাত্রীদের জল ও খাবার দিতে এই এলাকায় বেশ কয়েকটি ভাণ্ডারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেনা অফিসারদের মধ্যস্থতায় সেই ভাণ্ডারা থেকেই এখন আটকে পড়া পর্যটকদের খাবারের বাবস্থা করা হয়েছে।
সেই ক্যাম্পেই আটকে রয়েছেন বরাহনগরের বাসিন্দা শেলি দে। তাঁর কথায়, ‘‘সেনারা আমাদের সকলের ফোন নিয়ে নিয়েছে। তাঁরা খালি বলছেন, নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু বাইরের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় আমাদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে।’’ শেলিদেবী জানালেন, বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য একটা ফোন লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘বাথরুমে গিয়ে সেই ফোন থেকে বাড়ির লোকজনকে আমাদের অবস্থা জানাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে, আমরা কেউই জানি না।’’
ডানকুনির বাসিন্দা অপু মান্না। লাদাখের সুমোরিরি হ্রদ দেখার আশায় দু’সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে স্ত্রী সোমা ও ছেলে গুড্ডু। বললেন, ‘‘বছরে অন্তত দু’বার স্ত্রী-ছেলে নিয়ে বেড়াতে বেরোই। কিন্তু এ বার যা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হচ্ছে, তা আর বলার নয়!’’ কী ধরনের অভিজ্ঞতা? অপুর কথায়, ‘‘হঠাৎ আমাদের ক্যাম্প লক্ষ করে ইট ছুড়তে শুরু করে উন্মত্ত জনতা। আমাদের দল থেকে কয়েক জন পাল্টা ইট ছুড়লেই আগুনে ঘি-পড়ে। ক্যাম্পের লোকজনের সঙ্গে জনতার খণ্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়। তখনই রে রে করে ওঠেন সেনা অফিসারেরা। আমাদের হুমকি দেন— ‘আপনাদের নামে এফআইআর করে ফটকে পুরবো’। সেই হুমকি শুনেই ঘাবড়ে যাই আমরা।’’ সেই তাণ্ডবের বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্যাম্পে থাকা সৌগত বসুও বলেন, ‘‘বেড়াতে এসে শেষে কি না হাজতবাস করতে হবে! বাচ্চারা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। ভয়ে বমি করতে শুরু করে দেয় অনেকে।’’
সুব্রতবাবুই জানালেন, রবিবার রাত তিনটে থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত সেনা আর সিআরপি দফায় দফায় কড়া পাহারা দিয়ে পর্যটক আর তীর্থযাত্রীদের গাড়ি ছাড়তে শুরু করেছে। তবে শ্রীনগরে আর যেতে পারছেন না কেউই। প্রায় তিনশো গাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে জম্মুর দিকে। ‘‘খুব আশা নিয়ে বেরিয়েছিলাম। এখন তো ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনও গতি দেখছি না!’’