বিজেপির মিছিলে মোদীর মুখোশ হাতে এক যুবক। উত্তরপ্রদেশে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যেই মোদীর জনপ্রিয়তা বেশি। —ফাইল চিত্র
উত্তরপ্রদেশে বিজেপির উন্নয়নে তা হলে কি সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি? রাজ্যবাসী কি ‘উন্নয়নের অত্যাচারে’ অতিষ্ঠ? ‘‘না, সব কিছুতেই আমরা অতিষ্ঠ, এমন নয়,’’—বলেন সহেড়া গ্রামের কোঠেদার (রেশন ডিলার) তথা অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী ওমপ্রকাশ রাম। দলিত গ্রামটায় তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকটা মুখিয়ার মতো। ভিন্রাজ্যের সাংবাদিকের সামনে কোনও লুকোছাপাও নেই, আসল পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দেওয়ার গরজই স্পষ্ট বরং। বললেন, ‘‘বিজেপির নিচু তলার নেতাদের বিরুদ্ধে কিছু কিছু এলাকায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে ঠিকই। ইলেকট্রিক বিল বা সিলিন্ডারের দাম নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে। কিন্তু বিজেপি-কে ভোট না দেওয়ার একমাত্র কারণ সেটা নয়।’’ তা হলে? কলাভাজার প্লেট আর চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘বহেনজি এবং অখিলেশ, দু’জনেই বুঝতে পেরেছিলেন, এ বার হাত না মেলালে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে। বিজেপি যে ভাবে প্রভাব বাড়াচ্ছিল উত্তরপ্রদেশে, তা এখনই রুখে দেওয়া না গেলে দু’দলেরই (এসপি-বিএসপি) সমস্যা হয়ে যেত। তাই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরাও গঠবন্ধনের পাশেই আছি। কারণ জিতুন বা হারুন, উত্তরপ্রদেশের দলিত কখনও বহেনজির সঙ্গ ছাড়বে না।’’
অর্থাৎ এসপি-বিএসপি আলাদা আলাদা লড়লে উত্তরপ্রদেশে আবার চতুর্মুখী লড়াই হত। সে লড়াইয়ে বিজেপি ফের সুবিধা পেয়ে যেত। এবং ২০১৪ ও ২০১৭-র পরে এ বারও নির্বাচনী বিপর্যয়ের মুখে পড়লে এসপি-বিএসপি অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে যেত। সেই পরিস্থিতি এড়াতেই হাত মিলেয়েছেন মায়া-অখিলেশ আর সাফল্যের সঙ্গে সে সিদ্ধান্তের শরিক করে নিতে পেরেছেন কর্মী-সমর্থকদেরও। মায়া অনুগামী দলিত যে ভাবে চিরাচরিত আস্থার জায়গা থেকে নড়তে চাইছেন না, যাদব এবং মুসলিমও ঠিক সে ভাবেই মুলায়ম-অখিলেশের পাশে না দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারছেন না। কারণ উত্তরপ্রদেশে বিএসপি-র সঙ্গে দলিতের এবং এসপির সঙ্গে যাদব-মুসলিমের গাঁটছড়া শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিকও। সামাজিক ভাবেই বহেনজি বা নেতাজির নিজের নিজের সম্প্রদায় তাঁদের পাশে।
কিন্তু এসপি এবং বিএসপি-র মধ্যে গত দু’দশক ধরে প্রবল তিক্ত সম্পর্কের ইতিহাসও তো রয়েছে। শুধুমাত্র বিজেপি-কে রোখার তাগিদে সেই তিক্ততা রাতারাতি উধাও হয়ে যাবে? যাদবের ভোট মায়ার খাতায় বা দলিতের ভোট অখিলেশের ঝুলিতে জমা হবে? বহেনজির একনিষ্ঠ অনুগামী ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘জমা হবে। তিক্ততা এই মুহূর্তে অনেকটা কম এবং তিক্ততা কমানোয় অখিলেশ যাদবের ভূমিকা অনেকটাই।’’ কেন? কী এমন করলেন অখিলেশ? ওমপ্রকাশ বললেন, ‘‘বহেনজি যে অনেক সিনিয়র রাজনীতিক, তাঁকে যে উঁচু আসন দেওয়া উচিত, সেটা অখিলেশ বুঝেছেন। প্রকাশ্যে বহেনজির পা ছুঁয়েছেন তিনি, যে কোনও জনসভায় বহেনজির প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। ফলে আপাতত দু’দলের কর্মীদেরও একসঙ্গে কাজ করতে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।’’
যাদবরা বরাবরই অত্যন্ত প্রভাবশালী উত্তরপ্রদেশে। দলিতের উপরে অত্যাচারের যে সব আখ্যানের সাক্ষী উত্তরপ্রদেশ হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, সে সব আখ্যানে অভিযোগের আঙুল যদুবংশীদের দিকেও উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু মায়াবতীর প্রতি অখিলেশের সম্মান প্রদর্শন আপাতত মুছে দিয়েছে অনেক অপমান। ফলে যাদব-মুসলিম-দলিত সমাজের সিংহভাগ দাঁড়িয়ে গিয়েছে গঠবন্ধনের ছাতার তলায়। জনসংখ্যার এত বড় একটা অংশকে একত্র করার মতো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং উত্তরপ্রদেশের মাটিতে এর আগে কখনও জন্ম নিয়েছে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
অতএব বিজেপি বুঝে গিয়েছে, শুধু উন্নয়নের বুলিতে চিঁড়ে ভিজছে না। জাতপাতের অঙ্ক বিজেপি-কেও কষতে হচ্ছে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, ঠাকুর, ভূমিহার, কুমার, কুর্মি, নিষাদ-সহ নানা জাতির ভোট যে বিজেপির দিকেই যাবে, সে বিষয়ে নেতারা আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু যাদব-মুসলিম-দলিতের সব ভোট এক হয়ে গেলে জনসংখ্যার বাকি অংশ কি বিজেপির আগের বারের পারফরম্যান্সের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে? সন্দেহ বিস্তর। তাই এসপি-বিএসপির ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে হচ্ছে যোগী আদিত্যনাথ, কেশবপ্রসাদ মৌর্য বা মহেন্দ্রনাথ পাণ্ডেকে। ‘উন্নয়নের’ নামে, ‘আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির’ নামে, ‘সুরক্ষা এবং মজবুত ভারতের’ নামে আরও একবার মোদী সরকার গড়ার ডাক দিচ্ছেন তাঁরা। সে ডাকে সাড়া দিয়ে জাতপাতের বেড়া ডিঙিয়ে কিছু ভোট মোদীর ঝুলিতে জমা হতে পারে বলে বিজেপির আশা। তবে নিশ্চয়তা একেবারেই নেই।
মোদীর জন্য আশার আলো উত্তরপ্রদেশে কিছুটা জিইয়ে রাখছেন নতুন ভোটাররাও। যাদব বা দলিতের ঘরেও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মোদীর নামে জয়ধ্বনি শোনা যাচ্ছে কোথাও কোথাও। কিন্তু সেই সংখ্যা কি আদৌ এত বড় যে, মায়া-অখিলেশের অভূতপূর্ব সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে ব্যর্থ করে দেবে? বিজেপি কর্মীরাও খুব জোর দিয়ে তেমনটা বলতে পারছেন না। একটু হতোদ্যম হয়ে পড়ার আভাস দিয়েই বরং বলছেন, ‘‘এত উন্নয়নের পরেও যদি সেই জাতপাতের নামেই ভোট দেন মানুষ, তা হলে আর দেশটা এগোবে কী ভাবে?’’