Advertisement
০১ মে ২০২৪

এ বার পরিবারে নজর মোদীর

গত কাল বারাণসীর রাস্তায় মেগা রোড-শো যদি বিজেপির শক্তি দেখানোর দিন হয়, আজ তবে পালা ছিল ঐক্যবদ্ধ এনডিএ-র ছবি তুলে ধরার।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

ইন্দ্রজিৎ অধিকারী
বারাণসী শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫২
Share: Save:

ঝগড়া! কই কিছু হয়নি তো! শুক্রবার বারাণসীতে দ্বিতীয় বার মনোনয়ন পেশের পরে এনডিএ শরিকদের সঙ্গে ‘সুখী’ পরিবারের ছবি তুলে ধরে যেন এই বার্তাই দিতে চাইলেন নরেন্দ্র মোদী। একই সঙ্গে, নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রে এ ভাবে শরিক দলগুলির প্রায় সব প্রধান নেতাকে এক ছাদের তলায় হাজির করে সম্ভবত বোঝালেন, এনডিএ জোট থাকলেও তাদের তরফে এই ভোটে সব লোকসভা আসনে বকলমে তিনিই প্রার্থী। বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, বিজেপির আসন কমবে, এটা নিশ্চিত বুঝেই এখন শরিকদের মন পেতে মরিয়া মোদী।

গত কাল বারাণসীর রাস্তায় মেগা রোড-শো যদি বিজেপির শক্তি দেখানোর দিন হয়, আজ তবে পালা ছিল ঐক্যবদ্ধ এনডিএ-র ছবি তুলে ধরার। তাই সকালে প্রধানমন্ত্রী যখন বারাণসীর বুথকর্মীদের সামনে বক্তব্য রাখছেন, তখন হোটেলে শরিক নেতাদের সঙ্গে বসেছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। সঙ্গে তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী— রাজনাথ সিংহ, নীতীন গডকড়ী, সুষমা স্বরাজ। কথা তো হলই, প্রাতরাশও সারলেন এক সঙ্গে। স্থানীয় বিজেপি সমর্থকরা বলছিলেন, ‘‘মোদীজির জাদু! পাঁচ বছর যত ঝামেলাই হোক, ভোটে লড়তে নেমে ঠিক শরিকদের মিলিয়ে দিলেন তিনি।’’ এ জন্য অবশ্য অমিত শাহকেও কৃতিত্ব দিচ্ছেন তাঁরা। ‘জাদু’ আরও বোঝা গেল, মনোনয়ন পেশের আসরে। কাল যে মোদীর পরনে ছিল গেরুয়া, আজ তিনি সাদা পাঞ্জাবিতে! উপরে কালো মোদী জ্যাকেট। ভোটের সময়ে সারাক্ষণ দলের চিহ্ন পদ্ম লেপ্টে থাকে তাঁর বুকে। ২০১৪ সালে মনোনয়ন পেশের সময়ে গলায় যে উত্তরীয়টা ছিল, পদ্মের ছবি ছিল তাতেও। কিন্তু এ বার শরিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে মনোনয়ন পেশের সময়ে পদ্ম-ছাপ সে ভাবে চোখে পড়ল না। মোদী যেন তখন বিজেপি নন, এনডিএ প্রার্থী।

বুথকর্মীদের সামনে বক্তৃতা সেরে কালভৈরবের মন্দিরে পুজো দিয়ে মনোনয়ন জমা দিতে জেলাশাসকের দফতরে এলেন মোদী। সেখানে তখন তাঁর অপেক্ষায় শরিক নেতারা। ঘরে ঢুকেই প্রথমে একেবারে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন সব থেকে পুরনো শরিক অকালি দলের প্রকাশ সিংহ বাদলকে। ঘুরে ঘুরে কথা বললেন প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে। এই এডিএমকে-র পনীর সেলভমকে নমস্কার করছেন, তো এই সৌজন্য বিনিময় করছেন আর এক পুরনো শরিক শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, লোক জনশক্তি পার্টির রামবিলাস পাসোয়ানের সঙ্গে যেমন হাসিমুখে কথা বলছেন, তেমনই সময় দিচ্ছেন অসম এবং উত্তর-পূর্বের ছোট শরিক দলের নেতাদেরও।

দেখে কে বলবে, মাঝের পাঁচ বছরে প্রাপ্য গুরুত্ব ও সম্মান না দেওয়ার অভিযোগ মোদী-শাহের বিজেপির বিরুদ্ধে কত বার তুলেছেন এই নেতারা। ক্ষোভে মাঝে এনডিএ ছেড়ে লালুর সঙ্গে গিয়েছিলেন নীতীশ। মতান্তর তৈরি হয়েছিল অকালি দলের সঙ্গেও। অসম গণ পরিষদ শেষমেশ জোটে থাকবে কি না, তা বলা যাচ্ছিল না এই সে দিনও। সব থেকে তিক্ত লড়াই সম্ভবত হয়েছে দীর্ঘ দিনের শরিক শিবসেনার সঙ্গে। বারবার মোদীকে নিজেদের মুখপত্র সামনায় আক্রমণ করেছে উদ্ধবের দল। প্রধানমন্ত্রীকে ঝাঁঝালো আক্রমণ করেছেন খোদ উদ্ধব। বিরোধীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও প্রমাণ চেয়েছেন বালাকোটে হামলার। রাজনীতির ‘হাওয়া মোরগ’ হিসেবে পরিচিত রামবিলাসও মাঝে হিসেব চেয়েছিলেন নোটবন্দির ক্ষতির। এ দিন সব ঝগড়ার কঙ্কাল সিন্দুকবন্দি করে সুখী পরিবারের ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করলেন মোদী।

শুধু শরিক দলই বা কেন? বারাণসীর মাটি থেকে তো বার্তা রইল অন্যান্য দলের উদ্দেশেও। বুথকর্মীদের মোদী বললেন, ‘‘ভোটে লড়ুন। বুথের লড়াইয়ে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়ার প্রশ্ন নেই। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটটা পদ্মে দিতে বলুন। কিন্তু তা করতে গিয়ে রাজনৈতিক সংঘাতে জড়াবেন না। ভোটের প্রচারে, টিভির পর্দায় তর্ক চলুক। কিন্তু তা বলে কোনও প্রার্থীকে খারাপ ভাষায় আক্রমণ নয়।’’ শুনে বিরোধীরা বলছেন, অবস্থা বেগতিক বুঝেই এখন সমস্ত দরজা খোলা রাখতে চাইছেন মোদী। কাকে কখন দরকার পড়ে! কংগ্রেস নেতা রাজীব শুক্লর কথায়, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে এ দিন ভোট দেওয়ার আবেদন করেছেন, তাতে স্পষ্ট যে, প্রথম তিন দফায় হার নিশ্চিত বুঝছেন তিনিও। আমরাও তা-ই বলছি। আর বিজেপি একা জিতবে না বলেই এখন আস্থা রাখতে হচ্ছে শরিকদের উপরে।’’

জোটসঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে চলার যে সহজাত ক্ষমতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর ছিল, অনেকেই মনে করেন, মোদীর তা নেই। বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে ওই দলেরই অন্য কাউকে শরিকরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাইবেন কি না, সেই প্রশ্নও রয়েছে। অনেকে মনে করছেন, সেই কারণেই বারাণসী থেকে জোড়া বার্তা দিলেন মোদী। এক দিকে, দলের কর্মীদের তাতাতে প্রতি বুথ জেতার জন্য ঝাঁপাতে বললেন। অন্য দিকে, সুখী এনডিএ-র মুখিয়া হিসেবে তুলে ধরতে চাইলেন নিজেকে। দিন দুয়েক আগে এক ধাপ এগিয়ে অভিনেতা অক্ষয় কুমারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদী বলেছিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, গুলাম নবি আজাদ-সহ অনেক বিরোধী নেতার সঙ্গেই সুসম্পর্ক আছে তাঁর।

রাজনৈতিক মহলের মতে, এ-ও নিজের ভাবমূর্তিকে নতুন করে গড়ার স্পষ্ট কৌশল। সাধারণত কেন্দ্র বা রাজ্যে কোনও সরকার চলার পরে তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয় বড় অংশের মনে। এ দিন মোদীর দাবি, এ বার উল্টো হয়েছে। এই প্রথম প্রতিষ্ঠানের পক্ষে হাওয়া। বিরোধীদের বক্তব্য, মোদী মুখে এ কথা বললেও বিলক্ষণ জানেন, যে ‘অচ্ছে দিনে’র স্বপ্ন ফেরি করে তাঁর মসনদ দখল, পাঁচ বছরে তার খোঁজই পায়নি জনতা! নোটবন্দি-তড়িঘড়ি জিএসটির ধাক্কায় অর্থনীতি বেহাল। চাকরি নেই। কালো টাকা ফেরেনি। চরম দুরবস্থায় চাষিরা। এই অবস্থায় তাই আসন কমার দেওয়াল লিখন পড়তে পারছেন মোদী। সম্ভবত সেটা উঠে এসেছে দলের রিপোর্টেও। সেই কারণেই বাকি চার দফার ভোটে জান লড়িয়ে দিতে বারাণসীতে শক্তি প্রদর্শন। তাতেও চিঁড়ে ভিজতে না পারে আঁচ করে শরিকদের পাশে টানার চেষ্টা। দরজা খুলে রাখার বার্তা অন্যান্য দলের জন্যও।

মোদীর দাবি, প্রথম পাঁচ বছর প্রবল পরিশ্রম করেছেন তাঁরা। যার ফল মিলবে আগামী পাঁচ বছরে। অনেকে মনে করাচ্ছেন, গুজরাতে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবেও প্রথম দিকে একই যুক্তি দিতেন মোদী। বলতেন, শুধু কাজের পদ্ধতি ঠিক করতেই প্রথম পাঁচ বছর লেগে গিয়েছে তাঁর। শুক্ল বলছেন, তার মানে পাঁচ বছরে কিছুই না হওয়ার কথা নিজেই মেনে নিলেন মোদী।

গুজরাত বিশ্বাস করেছিল। হয়তো বারাণসীও করবে। সারা দেশ করবে কি না, উত্তর ২৩মে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE