Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Lok Sabha Election 2019

পণ্ডিতজি আর নেই, ম্যাডামের দুয়ারে বসে পুত্তনের চোখ ভিজে যায় আবেগপ্রবণ গাঁধী দুর্গে

শুধু শ্যামলালরা নন, ভোট যে এসে গিয়েছে, তা পুত্তনলালও বুঝতে পারছেন, বেশ উজ্জীবিতও হয়ে রয়েছেন তাই। পুত্তন অবশ্য শ্যামলালের মতো মহুয়ার জঙ্গল আর বন্‌জরের (পতিত জমি) মাঝে একলা দাঁড়িয়ে থাকা মাটির দাওয়ায় বসে নেই। তিনি বসে রয়েছেন ‘সনিয়া আবাসে’।

রায়বরেলীতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সনিয়া গাঁধী। ফাইল চিত্র।

রায়বরেলীতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সনিয়া গাঁধী। ফাইল চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
রায়বরেলী শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৯ ১৪:৫৯
Share: Save:

তখনও মনোনয়ন দাখিল করেননি সনিয়া গাঁধী। রুস্তমপুর দেহাতে পৌঁছনোর এবড়ো খেবড়ো রাস্তাটার প্রায় ঘাড়ের উপরে উঠে আসা বারান্দায় খাটিয়া পেতে বসে রয়েছেন শ্যামলাল। দোরের সামনে মাটির দাওয়ায় তাঁর স্ত্রী। সাইকেল, ফটফটিয়া (মোটরবাইক), বড়জোর অটোরিক্সা বা তিনচাকার পিকআপ ভ্যান ছাড়া অন্য কিছু সচরাচর চোখে পড়ে না যে রাস্তায়, সেখানে অচেনা গাড়ি দেখে দম্পতির চোখে ঈষৎ বিস্ময়ই ধরা পড়ে শুরুতে। তবে ঘোর কাটতেও সময় লাগে না। প্রবীণ দম্পতির মনে পড়ে যায়, ভোট এসে গিয়েছে।

শুধু শ্যামলালরা নন, ভোট যে এসে গিয়েছে, তা পুত্তনলালও বুঝতে পারছেন, বেশ উজ্জীবিতও হয়ে রয়েছেন তাই। পুত্তন অবশ্য শ্যামলালের মতো মহুয়ার জঙ্গল আর বন্‌জরের (পতিত জমি) মাঝে একলা দাঁড়িয়ে থাকা মাটির দাওয়ায় বসে নেই। তিনি বসে রয়েছেন ‘সনিয়া আবাসে’। সারা বছর বসে থাকেন আর অপেক্ষা করেন আরও এক বার সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তাই শ্যামলাল যখন শূন্য চোখে বসে রয়েছেন, পুত্তনলাল তখন ম্যাডামের পথ চেয়ে দিন গুনছেন এবং তাঁর চোখমুখ ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

বেশ কিছু একর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাদা পাঁচিল ঘেরা সাদা বাড়ি। লোহার ফটকে অস্বচ্ছ পলিথিন শিট সেঁটে দেওয়া, ভিতরে নজর যায় না। এটাই রায়বরেলীতে সনিয়া গাঁধীর বাড়ি। এলাকার সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পরে বানিয়েছিলেন। যখনই নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রে রাত কাটান, এই বাড়িতেই ওঠেন। বাড়িটার কোনও নাম নেই এমনিতে, কিন্তু স্থানীয়রা বলেন ‘সনিয়া আবাস’। পুত্তনলাল শুক্ল সেই বাড়িতেই কর্মরত। মেন গেট সংলগ্ন সিকিওরিটি কোয়ার্টারে বসে ঠায় নজর রাখেন রাস্তার দিকে। সনিয়া না থাকলে বাড়ি ঘিরে নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি তেমন একটা থাকে না। তাই পুত্তনই বাড়ির প্রধান রক্ষাকর্তা বছরভর। তবে ম্যাডাম আসার আগে থেকেই নিরাপত্তার মুড়ে ফেলা হয় সব কিছু। এসপিজি, পুলিশ, কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের আসা-যাওয়ায় গমগম করে ওঠে সনিয়া আবাস। পুত্তন তখনও থাকেন, কিন্তু অনেকের মধ্যে একজন হিসেবে থাকেন।

মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়ার আগে পুজো ও যজ্ঞ করছেন সনিয়া গাঁধী। ছবি: পিটিআই।

২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত একটানা রায়বরেলীর সাংসদ সনিয়া গাঁধী। তবে উত্তরপ্রদেশের এই লোকসভা কেন্দ্রের সঙ্গে গাঁধী পরিবার যোগ ওইটুকুতে সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতার পর থেকে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র তিন বার এই আসন কংগ্রেসের হাতছাড়া হয়েছে। এই কেন্দ্র দু’বার সংসদে পাঠিয়েছে ইন্দিরা গাঁধীকে। পরবর্তী কালেও শীলা কল বা সতীশ শর্মার মতো গাঁধী পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লোকজনই কংগ্রেসের টিকিটে বার বার রায়বরেলী থেকে জিতেছেন। আর সনিয়া নিজে চার বার (২০০৬-এর উপনির্বাচন-সহ) জয়ী হয়েছেন এই পারিবারিক দুর্গ থেকে এবং এ বারও তাঁর জয় নিয়ে রায়বরেলীর বাসিন্দাদের খুব একটা সংশয় নেই।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে অধিকাংশ সময়ই দেশের শাসন ক্ষমতা যে পরিবারের হাতে থাকল, সেই পরিবারের খাসতালুক হওয়া সত্ত্বেও রায়বরেলীর উন্নয়ন কতটুকু হল? প্রশ্ন তুলছে বিজেপি। প্রশ্নটাকে দোরে দোরে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টাও করছে। শ্যামলালের বারান্দায় বসে এলাকার হালহকিকত, উন্নয়ন-অনুন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প বাবদ প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং সাংসদের ভূমিকা বুঝে নেওয়ার চেষ্টা তাই নিরবচ্ছিন্ন থাকে না। হুড়হুড় করে গড়িয়ে আসে দ্বিচক্রযান। ঝপ্‌ করে নেমে স্ট্যান্ডটা ফেলেই খাটিয়ার অন্য কোনাটায় এসে বসে পড়ে সতীশ মিশ্র, কোনও অনুমতি নেওয়ার ধার ধারেন না।

এলাকার পরিচিত বিজেপি কর্মী সতীশ। বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়তে দেখে যেমন ধারণা তাঁর সম্পর্কে প্রথমেই তৈরি হয়েছিল, ততটা বিপজ্জনক বা বিরক্তিকর অবশ্য নন। আগ বাড়িয়ে কথোপকথনে নাক গলানোর চেষ্টা করেন না। প্রশ্নটা যত ক্ষণ না সরাসরি ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁর দিকে, তত ক্ষণ মুখ খোলেন না। তবে সুযোগটা পাওয়া মাত্র গড়গড় করে ক্ষোভের কথা বলতে শুরু করেন— ‘‘রাস্তাটা দেখছেন? এটাকে কি রাস্তা বলে? সাংসদ তহবিলের টাকায় এটা বানিয়ে দেওয়া যেত না? মাত্র আড়াই-তিন কিলোমিটার দূরে সনিয়া আবাস। তার ঠিক পিছনেই যে গ্রাম, সেখানকার রাস্তার এই হাল।’’ এতেই থামেন না সতীশ। ১৫ বছর ধরে যে এলাকার সাংসদ সনিয়া গাঁধী, সে এলাকায় সাকুল্যে ১৫ বারও কি সনিয়া এসেছেন? প্রশ্ন তোলেন তিনি। এলাকার মানুষ কি বিপদে-আপদে সনিয়া গাঁধীকে পাশে পান? বার বার যাঁকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠায় রায়বরেলী, তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগটাও কি পান এলাকার মানুষ? প্রশ্নের স্রোত বইয়ে দিতে থাকেন।

মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাচ্ছেন সনিয়া গাঁধী। ছবি: পিটিআই।

এতই যদি ক্ষোভ-বিক্ষোভ, সনিয়া গাঁধী বার বার জেতেন কী ভাবে এই আসন থেকে? সতীশ বলেন, ‘‘অনেক বড় নেত্রী উনি, জাতীয় স্তরের নেতা। তাই মানুষ ভোট দিয়ে দেন।’’ এ বার কি তা হলে মোহভঙ্গ হয়েছে? এ বার কি আর সনিয়া গাঁধীকে ভোট দেবে না রায়বরেলী? একনিষ্ঠ বিজেপি সমর্থকও এ প্রশ্নে হকচকিয়ে যান। ‘‘সে রকম কিছু হবে না। এখানে সনিয়া গাঁধীই আবার জিতবেন। কিন্তু মানুষকে বোঝানোটা আমাদের কাজ, তাই বোঝাচ্ছি।’’ হতোদ্যম স্বরে বলেন সতীশ মিশ্র। আর জীবনে কোনও দিন সাংসদের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি যিনি, দারিদ্রের সঙ্গে নিত্য যোঝার স্পষ্ট ছাপ যে শ্যামলালের ঘর-গৃহস্থালীতে বা পোশাক-আশাকে, তিনিও স্মিতহাস্যে এবং মৃদু মস্তক আন্দোলনে বুঝিয়ে দেন, তাঁর ভোটটা এ বারও সনিয়াই পাবেন।

পুত্তনলাল শুক্ল ডুব দেন নস্টালজিয়ায়। ‘‘ম্যাডামের তো এখন শরীরটা ভাল যায় না, এখানে আর খুব একটা আসতে পারেন না। আগে মাঝেমধ্যে আসতেন, পাঁচিলের ভিতরে প্যান্ডেল হত। গোটা জেলার কংগ্রেস নেতারা হাজির হতেন। ম্যাডাম সবার সঙ্গে কথা বলতেন। আর ভোটের সময়ে হলে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে সময় দিতেন।’’

পুত্তন নিজেই ‘পাঁচ বার’ দেখা করেছেন সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে। ‘‘পাঁচ বার, ভাবতে পারেন! একেবারে একা দেখা করেছি।’’ কথা বলতে বলতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে চোখ, সুখস্মৃতির ঢেউ খেলে যায় যেন মুখমণ্ডলে। ‘‘এ বারও আসবেন, এ বারও দেখা করব।’’ একগাল হাসি নিয়ে গদগদ হয়ে পড়েন সনিয়া আবাসের সর্বক্ষণের কর্মী। তবে স্মৃতির সরণিতে ফিরেই মুষড়েও পড়েন। ‘‘পণ্ডিতজি আর নেই, এ বার মনোনয়ন দাখিলের আগে পণ্ডিতজির বাড়িতে যজ্ঞটা আর হয়তো হবে না।’’ খেদোক্তি মিশে যায় খর্বকায় ব্রাহ্মণের নিঃশ্বাসে।

রায়বরেলীর মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন সনিয়া। ফাইল চিত্র।

কে পণ্ডিতজি? নেহরুর কথা বলছেন নাকি? পুত্তনের যা বয়স, তাতে নেহরুকে দেখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব! ‘‘না না, গয়াপ্রসাদজির কথা বলছি, গয়াপ্রসাদ শুক্ল।’’ খলখল করে হেসে ওঠেন প্রৌঢ়। গোটা রায়বরেলীতে ‘পণ্ডিতজি’ নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। কংগ্রেসের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। রায়বরেলী থেকে সনিয়া মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে প্রত্যেক বার সেই গয়াপ্রসাদের বাড়িতেই যজ্ঞ হত। পণ্ডিতজি নিজে যজ্ঞ করতেন, সনিয়া অংশ নিতেন। তার পরে মনোনয়ন জমা দিতে যেতেন। জানান পুত্তন। উত্তরপ্রদেশ স্বাস্থ্য দফতরের প্রাক্তন কর্মী পুত্তনকে সনিয়া গাঁধীর কাছে প্রথম বার পাঠিয়েছিলেন ওই গয়াপ্রসাদই। বদলির জেরে বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে চাকরি করতে হচ্ছিল। তাই গয়াপ্রসাদের পরামর্শে সরকারি চাকরি ছেড়ে সনিয়া আবাসে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন পুত্তন। পরিবারটার উপরে রায়বরেলীর বিশ্বাস এতটাই! ‘‘আগের বারও যজ্ঞটা হয়েছিল। এ বার আর পণ্ডিতজি নেই। যজ্ঞটা বোধ হয় আর হবে না।’’ চোখ ভিজে আসে পুত্তনের। শেষ বিকেলের হাওয়া বুঝিয়ে দেয়, সনিয়া গাঁধী বা গাঁধী পরিবারের সঙ্গে রায়বরেলীর সম্পর্কটা শুধু রাজনৈতিক নয়। গাঁধী পরিবার আর রায়বরেলী যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে পরস্পরকে। দীর্ঘ সংযোগ, আত্মীয়তা, নাড়ির টান, আবেগ, নস্টালজিয়া— অনেক কিছু মিশে রয়েছে এ সম্পর্কে। কোনও না কোনও ভাবে তাতে জড়িয়ে রয়েছেন এলাকার বাসিন্দারাও।

উত্তরপ্রদেশ জুড়ে কংগ্রেসের সংগঠন তলানিতে। গয়াপ্রসাদ শুক্লর মতো সর্বমান্য নেতা আর নেই। এলাকার ৫টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৩টিতেই হেরে গিয়েছে কংগ্রেস। দুই কংগ্রেস বিধায়কের মধ্যে একজন আবার বিজেপিতে চলে গিয়েছেন। এককালে রায়বরেলীর ভোটযুদ্ধে সনিয়ার অন্যতম প্রধান সেনাপতি হতেন যিনি, সেই দীনেশপ্রতাপ সিংহ এখন বিজেপি-তে। শুধু তাই নয়, দীনেশপ্রতাপই এ বার সনিয়ার বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী। তা সত্ত্বেও কোনও খামতি থাকতে দিল না রায়বরেলী। পুত্তনলালের আক্ষেপ ঘুচিয়ে যজ্ঞটা এ বারও হল। রায়বরেলীতে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার আয়োজন হল। রোড শো করে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পথে এগোলেন ইউপিএ চেয়ারপার্সন। রাস্তার দু’ধার আবার সেই আবেগেই ভেসে গেল। পুষ্পবৃষ্টিতে গাড়ির কাচ ঢেকে গেল। আর শ্যামলালের বারান্দা থেকে উঠে যাওয়ার সময়ে বিজেপি কর্মী সতীশ মিশ্র বলে গেলেন, ‘‘বিজেপি প্রার্থীর হয়ে ভোট চাইবই বা কী ভাবে? দীনেশপ্রতাপ এ বার প্রার্থী। এত দিন কংগ্রেসে থেকে এই লোকটাই সবচেয়ে বেশি লুঠতরাজ চালিয়েছেন। এঁর বিরুদ্ধেই তো আমাদের অভিযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। এ বার তাঁকেই ভোট দিতে বললে কেউ মানবে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE