ছবি এএফপি।
বছর পঞ্চাশ বাদে আবার শক্তিশেল!
একটু খুলেই বলতে হয়। ছোটবেলায় পারিবারিক সম্মেলনে সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’এ দূতের (বানর অবশ্যই) পার্ট পেয়েছিলাম। ছোট্ট ডায়লগ। ‘আজ্ঞে, আমি চান টান করেই পুঁইশাক চচ্চড়ি আর কুমড়ো ছেঁচকি দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়েই অমনি বেরিয়েছি....’ ইত্যাদি বলব, গৌরচন্দ্রিকা অধিক শুনে সকলে ‘মার ব্যাটাকে’ করবে, তখন আবার বলতে হবে, খেয়ে উঠে ঘণ্টাখানেক জিরিয়ে সেখানে গিয়ে দেখি ঢাকঢোল বাজছে, ঢ্যা রা রা ঢ্যা রা ...!
বুধবার দুপুরে সঙ্গে কুমড়ো ছিল না, ছিল এক ছড়া কাঁঠালি কলা। দমদম মেট্রো স্টেশনে বিপুল জলধিতরঙ্গ থেকে ব্যাগের মধ্যে কলার ছড়াটাকে রক্ষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছি, গায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়া সহযাত্রিণী ‘আমার পা, আমার পা’ বলে পরিত্রাহি চিৎকার করছেন, হঠাৎ মোবাইলে টুংটাং। নোটিফিকেশন— ‘পি এম মোদী উইল অ্যাড্রেস দ্য নেশন বিটউইন 11.45 টু 12.00’। ভিতরটা ধড়াস করে উঠল।
এ বার কী? যুদ্ধ? আবার নোটবাতিল? না কি...? মিত্রোঁ বলা তো ছেড়ে দিয়েছেন, এ বার তবে কী সম্ভাষণ?
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
ব্যাগের ভিতরে কলা (বলাও যাচ্ছে না, ব্যাগের ভিতরে কলা আছে— প্রেস্টিজে লাগে) এবং ব্যাগের বাইরে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে হঠাৎ দেখি, মিসড কল—দিল্লির সহকর্মীর। ভাবলাম, কী জানি, কী হয়ে গেল।
সামনে থেকে চিৎকার, ‘‘কী আবার হবে, ভিড় দেখেও উঠলেন? নেমে যান, নেমে যান।’’ যাঁকে বলা, তিনি বয়স্কা। উত্তর এল, ‘‘তুমি তো আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তুমি নেমে যাও। গিয়ে বাস ধরো। আমি কেন নামব?’’
পরবর্তী স্টেশন মহাত্মা গাঁধী রোড। একদল পুরুষ উঠলেন এবং এসে পড়লেন মহিলাদের ভিড়ে। সামনের সহযাত্রিণী, যিনি এতক্ষণ অন্যদের ব্যাগ এবং ভার বহন করেছিলেন, আর থাকতে পারলেন না। বললেন, ‘‘উপরের হ্যান্ডলটা ধরতে তো পারেন, গায়ে পড়ছেন, নামব কী করে?’’ ব্যস! আর যায় কোথায়?
‘‘নেমে যান, ট্যাক্সিতে করে যান।’’
‘‘আমি কেন ট্যাক্সিতে যাব, আপনারা যান।’’
‘‘বাড়িতে নিশ্চয় কিছু হয়েছে, তাই এখানে চেঁচাচ্ছেন।’’
‘‘আপনিও তো বাড়িতে কিছুই বলতে পারেন না, তাই মেট্রোতে মুখ খুলছেন।’’
আর এক জন যে-ই আবার বলেছেন, ‘‘অতই যদি গায়ে ফোস্কা পড়ে, ট্যাক্সিতে চড়ে যান,’’ পাশে দাঁড়ানো সহযাত্রিণী অমনি হা হা করে হেসে বললেন, ‘‘৫০ বছর ধরে তো একই কথা শুনছি— ট্যাক্সিতে করে যান। এ বার নতুন কিছু বলুন।’’ পুরুষকণ্ঠে ঝটিতি উত্তর, ‘‘ওলায় যান।’’
বেদম হাসি পেলেও চেপে রাখতে হল। ভিতরের ধড়াস ধড়াস ক্রমশই বাড়ছে, মোবাইলও দেখতে পাচ্ছি না, কী জানি কোথা থেকে কী হইয়া গেল! ভাবছিলাম, ‘‘বলেই দিই, ও মশাই, জানেন না তো দেশে কী হচ্ছে! ঝগড়া করে আর কী করবেন?’’ কিন্তু কিছু বলে ফেলে আবার না পস্তাই! লোকে হয়তো যুদ্ধু যুদ্ধু বা নোটবন্দি নোটবন্দি বলে চেঁচাতে চেঁচাতে কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে ফেলল।
স্টেশনে কোনও ক্রমে নেমেই মোবাইলে চোখ। তখনও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা শুরু করেননি। ১২টা বেজে গিয়েছে! আপিসে ঢুকতে ঢুকতে সাত পাঁচ ভেবে যাচ্ছি। যুদ্ধ হলে! কী কী স্টোরি হবে? তার চেয়েও বড় কথা, সহকর্মীরা অনেকেই রাজ্যের বাইরে, কেউ কেউ প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যুদ্ধ হলে আগে তো ফিরিয়ে আনতে হবে। মোবাইলে টাওয়ার পাব তো? ঠিকঠাক ফিরতে পারবে তো?
ইতিমধ্যে একটি টিভি চ্যানেলের সুবাদে ছড়িয়ে গিয়েছে, ‘বিগ ক্যাচ’! দাউদ ইব্রাহিম? তা হলে তো দাউদের প্রোফাইল, ছবি তো স্টকশট, বক্স, টাইমলাইন। টেলিভিশনের পর্দাতেও শুধুই আলোচনা, কী হবে? শুধু কনফার্ম করা গিয়েছে, মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক বৈঠক হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা সওয়া ১২টাও পেরিয়ে গেল। অতঃপর! প্রধানমন্ত্রী এলেন। ভাষণ শুরু করলেন, ‘অন্তরীক্ষ’ শব্দটা কানে ঢুকতেই ঝটিতি ভাবলাম, ভারতের মানুষ চলে গেল নাকি চাঁদে? তিনি কে? তাঁর তো প্রোফাইল চাই। গ্রাফিক কী হবে?
অচিরেই ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। শুনলাম, পুরুষ শাসক ৫৬ ইঞ্চি ছাতির কাহিনির পরে তিন মিনিটের ‘মিশন শক্তি’ বুঝিয়ে ভারতবাসীকে ভোটের আগে গর্বিত করতে চাইছেন। তিনি জানেনও না, মেট্রোবাসী পুরুষের মহাবিশ্বে মহাকাশে ভারতের পালক (কোনও নেত্রীর ভাষায় ‘পালঙ্ক’) নিয়ে ভাবনাই নেই। ‘ট্যাক্সি চড়ে যান, নেমে যান’ ইত্যাদি বস্তাপচা বুলি শুনিয়ে ‘বুলি’ করেই তাঁর ২৬ ইঞ্চি কৃতার্থ!
ও হ্যাঁ, লক্ষ্মণের শক্তিশেলে দূতের গানও ছিল, ‘... বাজে ঢক্ক ঢোল, মহা ধুমধাম, মহা হট্টগোল/... বীর দর্পে সবে করে কোলাহল, মহা আস্ফালনে কাঁপে ধরাতল।’
পার্ট ভুলে যাই বলে গানটা গাইতেই দেয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy