‘স্বদেশি’ পণ্যে জোর। জিএসটি-র বোঝা কমানো। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্রুত বাণিজ্য চুক্তি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রবল চাপের মুখে এই তিন ‘মন্ত্র’কে পুঁজি করে মোদী সরকার এগোতে চাইছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভারতের বাজার আমেরিকার পণ্যের জন্য খুলে দেওয়ার জন্য চাপ তৈরি করতে শুল্ক ও জরিমানা-সহ ৫০ শতাংশ করের বোঝা চাপানোর কথা বলেছেন। বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দর কষাকষি করতে আমেরিকার প্রতিনিধিদল দিল্লি সফরের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দিয়েছে। এই জোড়া চাপের মুখে আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ফের ‘স্বদেশি’ নীতিকে ঢাল করলেন।
রবিবারের সকালে দিল্লিতে একটি সড়ক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নতুন করে দেশের সামনে শুধু ভারতে তৈরি ‘স্বদেশি’ পণ্যেই ভরসা রাখার আর্জি জানিয়েছেন। এর আগে মোদী আসন্ন উৎসবের মরসুমে স্বদেশি পণ্য উপহার দেওয়ার কথা বলেছেন। এ বার ‘চরকাধারী মোহন’ বা মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গান্ধী চরকা চালিয়ে গোটা দেশকে স্বদেশির সামর্থ্য বুঝিয়েছিলেন। মোদী আজ ব্যবসায়ী, দোকানদারদের অনুরোধ জানিয়েছেন, ‘‘হয়তো কোনও সময় একটু বেশি মুনাফার জন্য আপনারা বিদেশি পণ্য বেচেছেন। কিন্তু এখন আমার ভোকাল ফর লোকাল মন্ত্রে সঙ্গ দিন। এর ফলে দেশের প্রতিটি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। অর্থনীতি মজবুত হবে।’’
সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুঁশিয়ারি অনুযায়ী যদি সত্যিই ভারত থেকে আমেরিকা পণ্যের উপরে ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং তার উপরে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করার জন্য আরও ২৫ শতাংশ জরিমানা— সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশ করের বোঝা চাপে, তা হলে ভারতের ছোট-মাঝারি শিল্পে বড় ধাক্কা লাগবে। বিশেষ করে চর্মশিল্প, অলঙ্কার, বস্ত্র শিল্পের মতো ক্ষেত্রে যেখানে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান হয়, সেখানে ধাক্কা লাগবে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী বার্তা দিতে চাইছেন যে, তিনি দেশের কৃষক, পশুপালকদের স্বার্থ রক্ষা করছেন। তাই আমেরিকার চাপ সত্ত্বেও ভারতের কৃষি ও ডেয়ারি শিল্পের বাজার আমেরিকার পণ্যের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে না।
অন্য দিকে আর্থিক ভাবে ট্রাম্পের শুল্কের মোকাবিলায় মোদী সরকার দেশের বাজারে কেনাবেচা বাড়াতে জিএসটি-তে সংস্কার করে করের বোঝা কমাতে চাইছে। সেই কারণেই জিএসটি-তে মাত্র দু’টি করের হার ৫% ও ১৮% চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্র। যার ফলে অধিকাংশ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যে জিএসটি-র হার ১২% থেকে কমে ৫% হবে। আজ মোদী বলেন, ‘‘জিএসটি-তে পরবর্তী ধাপের সংস্কার হতে চলেছে। দীপাবলিতে জিএসটি সংস্কারের ডাবল বোনাস মিলতে চলেছে। এর খসড়া রাজ্যগুলিকে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, সব রাজ্য কেন্দ্রের এই উদ্যোগে সহযোগিতা করবে। এর ফলে জিএসটি ব্যবস্থা সহজ হবে। করের হার সংশোধন হবে। গরিব, মধ্যবিত্ত থেকে ছোট-বড় সমস্ত উদ্যোগ, ব্যবসায়ীর এতে লাভ হবে।’’
পাশাপাশি আমেরিকা যখন ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে ‘ব্রেক’ কষছে, সে সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির পথে এগোতে চাইছে মোদী সরকার। ব্রিটেনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গিয়েছে। নয়াদিল্লি এ বার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নিউ জ়িল্যান্ড, পেরু, ওমানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দর কষাকষিতে গতি আনতে চাইছে। অস্ট্রেলিয়া ও চিলির মতো যে সব দেশের সঙ্গে ইতিমধ্যেই বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, তার আওতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। রবিবারই কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গয়াল অস্ট্রেলিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী ডন ফ্যারেলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গয়াল জানিয়েছেন, দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও লগ্নি বাড়াতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া বাণিজ্য চুক্তির দ্বিতীয় দফা চূড়ান্ত করা নিয়ে কথা হয়েছে। মোদী সরকার ব্রাজ়িল, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ব্রিকস-এর দুই দেশের সঙ্গেও নতুন করে আলোচনা শুরু করতে চাইছে।
শিল্প মহলে অবশ্য সংশয় হল, ভারতের রফতানির প্রায় ১৮ শতাংশ আমেরিকায় যায়। ভারতের আমদানির প্রায় ১৫ শতাংশ চিন থেকে আসে। স্বদেশি পণ্য কেনাবেচায় জোর দিয়ে, জিএসটি কমিয়ে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করে কি আমেরিকা-চিনের উপরে নির্ভরতা কমানো যাবে? সরকারি সূত্রের বক্তব্য, আমেরিকার চাপের মুখে এক দিকে যেমন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে মজবুত করার চেষ্টা হচ্ছে, তেমনই চিনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই সোমবার দিল্লিতে আসছেন। তিনি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও দেখা করবেন। তার পরে মোদীরও চিন সফর রয়েছে। ফলে ট্রাম্পের চাপের মুখে চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোন খাতে বইবে, সেটাও দেখার বিষয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)