Advertisement
২১ মে ২০২৪

ইতিবাচকেও নীতির অভাবই কাঁটা

শুধু শুকনো কথায় আর চিঁড়ে ভিজবে না। নরেন্দ্র মোদী সরকারের দশ মাস কেটে যাওয়ার পরে শিল্পপতিরা এ কথা বলতে শুরু করেছেন। এ বার একই কথা শোনা গেল আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা মুডি’জ-এর পর্যালোচনায়। মুডি’জ অবশ্য আজ ভারতীয় অর্থনীতিতে লগ্নি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এত দিন তারা মনে করত, এ দেশের অর্থনীতি ‘স্থিতিশীল’। আজ তা বদলে তারা জানিয়েছে, ভারতের অর্থনীতি ‘ইতিবাচক’। মুডি’জ মনে করছে, সরকার যে সব পদক্ষেপ করেছে বা করছে, তাতে একটা ইতিবাচক নকশা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার বাস্তব রূপায়ণ এখনও হয়নি। যে কথার সঙ্গে একমত হয়ে শিল্পমহলও জানিয়েছে, ধীরে এগোলে এই ইতিবাচক পরিস্থিতি কাজে লাগানো যাবে না। সে জন্য চাই দ্রুত ব্যবস্থা। আর সেটা এখনও করে দেখাতে পারেনি মোদী সরকার।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৩০
Share: Save:

শুধু শুকনো কথায় আর চিঁড়ে ভিজবে না। নরেন্দ্র মোদী সরকারের দশ মাস কেটে যাওয়ার পরে শিল্পপতিরা এ কথা বলতে শুরু করেছেন। এ বার একই কথা শোনা গেল আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা মুডি’জ-এর পর্যালোচনায়।

মুডি’জ অবশ্য আজ ভারতীয় অর্থনীতিতে লগ্নি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এত দিন তারা মনে করত, এ দেশের অর্থনীতি ‘স্থিতিশীল’। আজ তা বদলে তারা জানিয়েছে, ভারতের অর্থনীতি ‘ইতিবাচক’। মুডি’জ মনে করছে, সরকার যে সব পদক্ষেপ করেছে বা করছে, তাতে একটা ইতিবাচক নকশা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার বাস্তব রূপায়ণ এখনও হয়নি। যে কথার সঙ্গে একমত হয়ে শিল্পমহলও জানিয়েছে, ধীরে এগোলে এই ইতিবাচক পরিস্থিতি কাজে লাগানো যাবে না। সে জন্য চাই দ্রুত ব্যবস্থা। আর সেটা এখনও করে দেখাতে পারেনি মোদী সরকার।

মুডি’জ-এর মতো স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর’স, ফিচ-এরও এত দিন ভারত সম্পর্কে বক্তব্য ছিল, এ দেশের অর্থনীতি ‘স্থিতিশীল’। ফিচ-ও এ দিন তাদের রেটিং জানিয়েছে। তারা কিন্তু তাদের পুরনো ধারণা এখনও বদলায়নি। তাদের বক্তব্য, কিছু প্রচেষ্টা আছে ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছুই হয়নি। সে কারণে তারা ভারত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি একই রেখেছে।

মুডি’জ-এর বেলাতেও কাহিনি প্রায় এক। তারা রেটিং সামান্য বাড়ালেও ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে মূল্যায়ন বদলায়নি। উল্টে সতর্কবার্তা দিয়ে বলেছে, এই মূল্যায়ন তখনই বদলাবে যখন মোদী সরকার শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাস্তবিকই ইতিবাচক পদক্ষেপ করবে। যে ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি মোদী দিয়েছেন, আর্থিক বিকাশের ক্ষেত্রে তার দেখা মিলবে।

মুডি’জ-এর এই বক্তব্যের সঙ্গেও একমত শিল্পমহল। তাঁরাও মানছেন, নতুন সরকারের আমলে কিছু কাজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিক ছবিটাকে বদলে দেওয়ার পক্ষে তা অকিঞ্চিৎকর। শিল্পমহল বলছে, ইউপিএ-২ আমলে নীতি পঙ্গুত্ব দেখা দিয়েছিল। রাজনৈতিক চাপে সংস্কার এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি মনমোহন সিংহ। এই সরকার তার থেকে সামান্য হলেও বদল এনেছে। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। বিদেশি লগ্নির জন্য আরও বেশি করে দরজাও খুলে দিয়েছে সরকার। লগ্নি টানতে প্রক্রিয়া সরল করেছে। পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নীতির ব্যাপারে এখনও সেই তিমিরে পড়ে রয়েছে সরকার। লাল ফিতের ফাঁস পুরোপুরি খোলার মতো দৃষ্টিভঙ্গি এই সরকারের এখনও নেই।

শিল্পমহলের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও মানছেন, গত দশ মাসে সরকার যা করেছে, সেটুকুতে হবে না। আরও করতে হবে। আজ মুডি’জ-এর দৃষ্টিভঙ্গি বদলের পর কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও বলেছেন, ‘‘আরও কাজ করতে হবে।’’ কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। এখন যাবতীয় সিদ্ধান্তের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর দফতরের হাতে। ফলে একে তো সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হচ্ছে, তার সঙ্গে দূরদৃষ্টির অভাবও দেখা যাচ্ছে। শিল্পমহলের একাংশ বলছে, আগের সরকারের যদি নীতিপঙ্গুত্ব থাকে, এই সরকারের তো নীতিই নেই!

ভারতের আর্থিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মুডি’জ-এর অর্থনীতিবিদ অতসী শেঠও সে কথাই বলেছেন। নতুন লগ্নির জন্য যে আর্থিক সংস্কার দরকার, লাল ফিতের ফাঁস

কাটানো দরকার, সেই কাজ এখনও অনেক বাকি। শ্রম আইন সংস্কারের কাজও আটকে রয়েছে। অরুণ জেটলি বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছেন, সংস্কারের কাজ এক পা এক পা করে এগোচ্ছে। কিন্তু শিল্পমহলের বক্তব্য, সংস্কারের কাজ কামারের এক ঘা মেরেই করতে হয়। ঠুকঠুক করে হয় না। এমনকী, দেশে জ্বালানি তেলের দাম কমানো নিয়ে বিজেপির নেতানেত্রীরা যে মোদী সরকারের কৃতিত্ব দাবি করে, তাকেও শিল্পপতিরা নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমায় মূল্যবৃদ্ধি কমেছে। এখানে মোদী সরকারের কোনও কৃতিত্ব নেই।

কেন এই পরিস্থিতি? বিজেপির লোকজন তো বটেই, রাজনীতিকদের একংাশও বলছেন, সরকারের মূল সমস্যা মোদী সম্পর্কে জনতার প্রবল প্রত্যাশা। ইউপিএ-২ আমলে নীতিপঙ্গুত্বে দেশের অর্থনীতি থমকে ছিল। মোদী ক্ষমতায় এলে তাঁর সম্পর্কে মানুষের ধারণা হল, তিনি মন্ত্রবলে সব বদলে দেবেন। এখন বছর ঘোরার মুখে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি বিশেষ না হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, ‘অচ্ছে দিন’ এলো কোথায়? উল্টো দিকে কেউ কেউ প্রচার করছেন, মোদী সরকার আসলে শিল্পপতিদের সরকার। সনিয়াও এই স্লোগান তুলে মোদী-বিরোধী প্রচারে নেমেছেন।

এই দুইয়ের সঙ্গে এখন লড়তে হচ্ছে মোদীকে। তাই তিনি আজই একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে যুক্তি দিয়েছেন, ‘কংগ্রেস বলছে আমরা শিল্পপতিদের সরকার। শিল্পপতিরা বলছেন, আমরা তাঁদের জন্য কিছুই করছি না। দু’টি অভিযোগ একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না।’ মোদীর বক্তব্য, ‘‘আমার কাজ নীতির ভিত্তিতে সরকার চালানো। লাল ফিতের ফাঁস থাকবে না মানে এই নয় যে, মুকেশ অম্বানীর জন্য লাল ফিতে থাকবে না, কিন্তু মানুষের জন্য থাকবে!’’ তাঁর যুক্তি, শ্রম আইনের সংস্কারও শুধু লগ্নিকারীদের স্বার্থ দেখে নয়, কর্মসংস্থানের কথা ভেবে করতে হবে।

সরকার যে সংস্কারের কর্মসূচি নিয়েই চলছে, সে কথা জোর গলায় বলেছেন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম। তিনি বলেন, ‘‘সরকারের সংস্কারের কর্মসূচির জন্যই দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। আমরা বলছিলাম, বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ছে। তারই প্রমাণ মিলেছে আজ।’’

শিল্পপতিরা বা রেটিং সংস্থাগুলি, কেউই কিন্তু পুরোপুরি আশা ছাড়েনি। মুডি’জ-এর বক্তব্য, মোদী সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে। লগ্নি টানার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়ার কিছুটা সরলীকরণ হয়েছে। বিদেশি লগ্নির জন্য আরও বেশি করে দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে। এ ভাবেই ছবিটা ভাল হতে থাকলে, আগামী এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে ভারত সম্পর্কে মূল্যায়ন বা রেটিং উন্নত হতে পারে।

শিল্পপতি-অর্থনীবিদদের বক্তব্য, অন্তত একটি আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থা ভারতের অর্থনীতি সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। এটা হেলাফেলার নয়। এর ফলে নয়া লগ্নি আসার পথ সুগম হতে পারে। আজই মোদী জার্মানি, ফ্রান্স ও কানাডা সফরে গিয়েছে। তিনটি দেশের শিল্পপতিদেরই ভারতে লগ্নির জন্য ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র প্রচার করবেন তিনি। তার আগে মুডি’জ-এর মূল্যায়ন মোদীর ঝুলিতে বাড়তি অস্ত্র জোগাবে। অর্থসচিব রাজীব মেহরিশির বক্তব্য, বাজেটে যে সব নীতি ঘোষণা হয়েছে, তাতেই সিলমোহর পড়ল।

তার আগে যথেষ্ট কাজ বাকি, মনে করাচ্ছেন মুডি’জ-এর অর্থনীতিবিদ অতসী শেঠ। তাঁর বক্তব্য, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরানোর ক্ষেত্রে মোদী সরকারকে দ্রুত কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সরকারের মালিকানাই বেশি। তার হার কমানোর কাজ বাকি। একই সঙ্গে ব্যাঙ্কে পুঁজির অভাব ও অনাদায়ী ঋণও চিন্তার কারণ। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ফেরাতে হলে আগে ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার প্রয়োজন। তা হলেই এক থেকে দেড় বছরে ভারতের মূল্যায়ন বা রেটিং উন্নত হতে পারে। তাঁর বক্তব্য, নীতি বানিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির চেষ্টা না করলে বৃদ্ধি থমকাবে। হয় মূল্যবৃদ্ধি বাধা হয়ে দাঁড়াবে, নয়তো চালু খাতার ঘাটতি সমস্যা তৈরি করবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE