বিরোধীদের ‘মহাগঠবন্ধনে’র তরফে তেজস্বী যাদবকে সম্মিলিত ভাবে যে দিন মুখ্যমন্ত্রী-মুখ হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে, পটনার অভিজাত হোটেলে তাঁর ‘স্যুইট’-এ খিল এঁটে বসে ছিলেন মুকেশ সাহনি! তাঁর ‘বিকাশশীল ইনসান পার্টি’ (ভিআইপি)-র জন্য ২৫টি আসন এবং উপ-মুখ্যমন্ত্রীর পদের আশ্বাস ছাড়া তিনি বিরোধীদের সঙ্গে সহমত হতে রাজি নন। শেষ পর্যন্ত তেজস্বী তাঁর ঘরে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, মুকেশকে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করার ঘোষণা করে দেওয়া হবে। তবে বিধানসভায় এখন ২৫টি আসন দেওয়া যাবে না, পরে বিধান পরিষদ ও রাজ্যসভার কথা ভাবা হবে। আশ্বাস পেয়ে গোসা-ঘর থেকে বেরিয়ে বাকি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়েছিলেন মুকেশ।
এমন নাটকীয়তার পরে কী হল? ভিআইপি-র ১৫ আসনের তালিকা প্রকাশের পরে দেখা গেল, সেখানে মুকেশের নাম নেই! তাঁর ভাই সন্তোষ সাহনি লড়ছেন। অর্থাৎ ভোটের পরে সরকার হলে যিনি উপ-মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তিনি সরাসরি জনমত যাচাই করতে ময়দানেই নামছেন না! মুকেশ অবশ্য একমাত্র নন। বিহারের এ বারের বিধানসভা নির্বাচনের ময়দান সে অর্থে তারকাহীন। আরজেডি-র তেজস্বী ছাড়া বিহারের খুব ওজনদার কোনও নেতাই ভাগ্য পরীক্ষা করতে প্রার্থী হয়ে দাঁড়াননি। বাইরে থেকে দর কষাকষির দিকেই তাঁদের নজর অনেক বেশি।
দুই পর্বের ভোটের মনোনয়ন প্রত্যাহার-পর্ব মিটে যাওয়ার পরে ছবিটা এক বার দেখে নেওয়া যাক। বিহারের ভোট-রাজনীতিতে তেজস্বী ছাড়া যিনি এই মুহূর্তে সব চেয়ে বেশি চর্চিত, সেই নীতীশ কুমার বিধানসভা ভোটে প্রার্থী নন। বহু বছর ধরেই তিনি আইনসভার উচ্চ কক্ষ বিধান পরিষদেই স্বচ্ছন্দ। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগে ভোটে জিতে বিধায়ক হয়েছিলেন। লোকসভার সাংসদ-জীবন শেষ করার পর থেকে বিধান পরিষদে। তাঁর দল জেডিইউ-এর নেতা বিজয় কুমার চৌধরি, উমেশ সিংহ কুশওয়াহা, সাবির আলিরা অবশ্য ভোটে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু নিজস্ব বৃত্তের বাইরে তাঁদের কেউ এক ডাকে চেনে না।
বিজেপির দুই উপ-মুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধরি তারাপুর এবং বিজয় কুমার সিন্হা লখীসরাই থেকে প্রার্থী। রামকৃপাল যাদব দানাপুরে, তারকিশোর প্রসাদ কাটিহারে লড়ছেন। বিদায়ী সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং বাংলায় বিজেপির সাংগঠনিক সহ-পর্যবেক্ষক মঙ্গল পাণ্ডে সিওয়ান থেকে প্রার্থী। এঁদের সঙ্গে বিতর্ক জড়িয়ে থাকলেও সেই বৃহত্তর পরিচিতি নেই। ভোটের ফল পক্ষে গেলে নীতীশের বদলে বিজেপি নিজেদের কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করলে তাই ‘চমকে’র উপাদানই থাকবে। বিহারে সাম্প্রতিক কালে হইচই ফেলে দেওয়া চিরাগ পাসোয়ান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিধানসভা ভোটে লড়ছেন না। তাঁর লোক জনশক্তি পার্টি (রামবিলাস)-র টিকিট অবশ্য ভাগ্নেকে দিয়েছেন। এনডিএ-র শরিক ‘হম’-এর নেতা জিতন রাম মাঞ্ঝি কেন্দ্রের মন্ত্রী, বিধানসভায় প্রার্থী নন। তাঁর পুত্রবধূ দীপা ইমামগঞ্জ থেকে বিধায়ক ছিলেন, এ বারও প্রার্থী। রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চার উপেন্দ্র কুশওয়াহা রাজ্যসভায় আছেন, বিধানসভার মাঠে নামেননি। সাসারাম থেকে তাঁর স্ত্রী স্নেহলতাকে টিকিট দিয়েছেন। আসন ভাগের সময়ে এই নেতারা সকলেই কিন্তু প্রাণপণে ঝাঁপিয়েছিলেন!
বিরোধী শিবিরে নজর করলে প্রথমেই বলতে হবে, বিহারের চিররঙিন চরিত্র লালুপ্রসাদ বৃদ্ধ হয়েছেন। তাঁর কথার গুরুত্ব এখনও আছে, ভোট-মানচিত্রে আর তিনি নেই। তাঁর স্ত্রী রাবড়ী দেবী বিধান পরিষদে চলে গিয়েছেন। তাঁদের ‘ত্যাজ্যপুত্র’ তেজপ্রতাপ যাদব দাদির ছবি হাতে নিয়ে জনশক্তি জনতা দলের হয়ে মহুয়া কেন্দ্রে মনোনয়ন দিয়ে এসেছেন। আরজেডি-র সঙ্গী কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি রাজেশ রাম কুডুম্বা থেকে এবং বিদায়ী বিধানসভায় কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা শাকিল আহমেদ খান (এক সময়ে বাংলায় পর্যবেক্ষক ছিলেন) কাডোয়া থেকে প্রার্থী। তবে তাঁদেরও সর্বত্র সকলে এক ডাকে চেনে না। আর আছেন জন সুরাজের প্রশান্ত কিশোর (পি কে)। তিনিও নিজে লড়ছেন না।
বাংলায় দীর্ঘ দিন সাতগাছিয়ার পরিচিতি ছিল জ্যোতি বসুর কেন্দ্র হিসেবে। মালদহের বরকত গনি খান চৌধুরী অশক্ত শরীরেও ভোটের ময়দানে থেকেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নানা দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সরাসরি জনতার ভোটের পরীক্ষায় সব সময়ে হাজির। যার সঙ্গে এই বিহারের প্রায় কোনও মিলই নেই! বিহার কংগ্রেসের নেতা ব্রিজেশ পাণ্ডের কথায়, ‘‘যাঁরা এখন লড়ছেন, তাঁদের মধ্যে থেকেই পরবর্তী কালের নেতারা উঠে আসবেন।’’ পি কে-র মত, ‘‘একটা কেন্দ্রে লড়ার চেয়ে গোটা রাজ্যে প্রচারকে হয়তো বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)