ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইন নিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর বক্তব্য, এই প্রস্তাবগুচ্ছ ‘পূর্ব এশিয়া-সহ গাজ়ায় দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সঠিক এবং ব্যবহারিক পথ’। প্যালেস্টাইন ও ইজ়রায়েল, অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলি ট্রাম্পের এই প্রস্তাব মেনে নেবে বলেই তাঁর আশা। নিজের এক্স হ্যান্ডলে এক পোস্টে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘গাজ়া সংঘাতের অবসানে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ব্যাপক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন, তাকে আমরা স্বাগত জানাই। এটি প্যালেস্টাইন ও ইজ়রায়েলি জনগণের পাশাপাশি বৃহত্তর পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের একটি বাস্তব পথ তুলে ধরবে। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উদ্যোগে ঐক্যবদ্ধ হবে এবং সংঘাতের অবসান ঘটাবে। শান্তি নিশ্চিত করার এই প্রচেষ্টাকে সবাই সমর্থন করবে।’
ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনের সংঘাতের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ভারত নিক্তি মেপে কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোট দিয়ে থাকে। ট্রাম্পের এ হেন নতুন প্রস্তাবে মোদীর দ্রুত পাশে দাঁড়ানো নিয়ে কূটনৈতিক মহলে তাই প্রশ্ন এবং বিতর্ক শুরু হয়েছে। ঘটনা হল, এই বিষয়টি নিয়ে ভারতের চিরাচরিত এবং ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে। ভারত ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইন প্রশ্নে আলোচনার মাধ্যমে 'দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান' চায়। ট্রাম্পের প্রস্তাব ভারতের সেই অবস্থানের সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, তা খতিয়ে না দেখেই মোদী কেন প্রস্তাবকে বিশদে সমর্থন করলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
পাশাপাশি আরও একটি বিষয় সামনে চলে আসছে। যে প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন মোদী, তাতে আগেই সিলমোহর দিয়ে ট্রাম্পের কাছে আবারও উচ্চপ্রশংসিত হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ এবং সে দেশের সেনাপ্রধান আসিম মুনির। পহেলগাম হামলায় যাঁদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভূমিকা নিয়ে ভারত নিঃসন্দেহ। সোমবার হোয়াইট হাউসের সাংবাদিক বৈঠকে ট্রাম্প বলেন, “পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (শাহবাজ়) এবং ফিল্ড মার্শাল (সেনাপ্রধান মুনির) শুরুর দিন থেকে আমাদের সঙ্গে রয়েছেন। তাঁরা কেবল একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন যে, পাকিস্তান এই চুক্তির (শান্তি প্রস্তাব) উপর পুরোপুরি ভরসা রাখছে।”
কূটনৈতিক শিবিরের প্রশ্ন, আমেরিকার এই গাজ়া প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে এক থালায় ভাত খেতে গেল কেন ভারত? এমনটাও মনে করা হচ্ছে, তা হলে কি ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যচুক্তির কথা মাথায় রেখেই নোবেল প্রত্যাশী ট্রাম্পকে পাকিস্তানের মতোই ভারতও কিছুটা উস্কানি দিচ্ছে? রণকৌশলগত বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানির কথায়, "এই তথাকথিত গাজ়া শান্তি চুক্তি আসলে ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু-র চূড়ান্ত হুমকি। সেটা হল, হামাসকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত বন্দিকে ছেড়ে দিতে হবে, সম্পূর্ণ অস্ত্রত্যাগ করতে হবে, ইজ়রায়েলের সব বাফার জ়োনকে মেনে নিতে হবে তাদের ভূখণ্ড হিসাবে। দুর্বল করে দেওয়া হবে হামাসকে। বলা হচ্ছে, হয় তারা অবমাননাকে মেনে নিক, অথবা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। প্রস্তাবে এই সতর্কতাও দেওয়া হয়েছে, যদি প্যালেস্টাইনের সামরিক সংগঠনটি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তা হলে নেতানিয়াহু 'যা করতে চান তা করতে' তিনি (ট্রাম্প) সম্মতি দেবেন।" ব্রহ্মা চেলানির কথায়, "স্বনিযুক্ত শান্তির দূত ডোনাল্ড ট্রাম্প যে ভাবে শান্তিকে ব্যাখ্যা করে থাকেন, তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল এই গাজ়া প্রস্তাব। সেই ব্যাখ্যাটি হল, হয় আত্মসমর্পন কর, নয়তো গর্দান দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হও!"
প্রসঙ্গত ট্রাম্পের ২০ দফা প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, উভয় পক্ষের চুক্তিতে ইজ়রায়েলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে। হামাসের হাতে থাকা সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে। প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে একটি টেকনোক্র্যাটিক, অরাজনৈতিক কমিটি গঠন করা হবে। তারাই সরকারি পরিষেবা এবং দৈনন্দিন প্রশাসনিক পরিচালনা চালাবে। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন একটি 'বোর্ড অব পিস' এই কমিটির তত্ত্বাবধানে থাকবে এবং এতে ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার-সহ অন্যান্য বিশ্ব নেতারা অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। গাজ়ার অভ্যন্তরে ইজ়রায়েলি 'নিরাপত্তা পরিধি' বজায় রাখবে। এর অর্থ, ইজ়রায়েল গাজার অভ্যন্তরে একটি বাফার জ়োন রাখবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, গাজ়ায় ভবিষ্যতে প্যালেস্টাইন 'জঙ্গি গোষ্ঠী' হামাসের কোনও ভূমিকা থাকবে না।
কূটনৈতিক মহলের বক্তব্য, মোদী এই সূত্রে সমর্থন জানিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ভারতীয় অবস্থানের সঙ্গে এর কোনও সঙ্গতি নেই। প্যালেস্টাইন সঙ্কট সমাধানে নয়াদিল্লির দ্বিরাষ্ট্রীয় নীতি হল, দু’পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছনো, যেখানে নিরাপদ এবং স্বীকৃত সীমান্তের মধ্যে একটি স্বাধীন সার্বভৌম কার্যকর প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। যেখানে ইজ়রায়েলের সঙ্গে তাদের শান্তিতে বসবাস করা সম্ভব হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)