বৃহস্পতি ও শুক্রবার, ৯-১০ নভেম্বর গুয়াহাটিতে জিএসটি পরিষদের বৈঠক বসছে। তার আগেই, সোমবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই আগাম জানিয়ে দিলেন, দিনকয়েকের মধ্যে জিএসটি সংক্রান্ত সুখবর পাবেন ব্যবসায়ীরা। জিএসটি পরিষদই পণ্য ও পরিষেবা করের হার সংশোধনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সর্বোচ্চ সংস্থা। তাই প্রধানমন্ত্রী কী করে আগেই সুখবরের প্রতিশ্রুতি দিতে পারেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
মোদীর বিতর্কিত আগাম ঘোষণাই নয়, ‘কম্পোজিশন স্কিম’-এর মোড়কে গুয়াহাটি বৈঠকে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে যে গুচ্ছ-ঘোষণা হতে চলেছে, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্য এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। কারণ, ছোট ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে কেন্দ্র বাস্তবে বিশালসংখ্যক ব্যবসায়ীকে কর এড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন জিএসটি পরিষদের অনেকেই। কর কর্তাদের একাংশের মতে, কেন্দ্র আসলে জিএসটির মধ্যেই ‘জিএসটি বর্হিভূত’ একটি ব্যবস্থা করতে চাইছে। অনেকে আবার এর নেপথ্যে গুজরাত, হিমাচলপ্রদেশ, কর্নাটকের ভোটের অঙ্কও দেখছেন।
আরও পড়ুন: কালো টাকার নথিতে চাপে প্রধানমন্ত্রী
কেন এই বিবাদ? জিএসটি আইনে কম্পোজিশন স্কিম নামে একটি বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থায় যাঁরা একেবারেই ছোট ব্যবসায়ী তাঁদের প্রতিমাসে একাধিক রিটার্নের বদলে বছরে চারটি রিটার্ন দিতে হয়। রাজ্যের সীমানার মধ্যে বছরে ৭৫ লক্ষ টাকার ব্যবসা করেন যাঁরা, এই স্কিমে শুধুমাত্র তাঁরাই মোট ব্যবসার উপর ১% কর দেওয়ার সুবিধা পেতে পারেন। এই ব্যবস্থা অনেকটা টার্নওভার ট্যাক্সের সমতুল। এখনও পর্যন্ত জিএসটিতে নাম লেখানো ১ কোটি ব্যবসায়ীর মাত্র ১৫ লক্ষ এই স্কিমে নথিভুক্ত হয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ-সহ একাধিক রাজ্যের অভিযোগ, এই কম্পোজিশন স্কিমের ফাঁকে কেন্দ্র আসলে বিশালসংখ্যক ব্যবসায়ীকে বছরে চার খেপে মোট ব্যবসার উপর সামান্য কর দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। তাঁদের জিএসটির ঝামেলা থেকে কার্যত মুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এই স্কিমে নথিভুক্ত হলে সেই ব্যবসায়ী বা উৎপাদকরা ভিন রাজ্যে পণ্য পাঠাতে পারেন না। সেটাও এখন তুলে দিতে চাইছে কেন্দ্র। ফলে গুজরাতের ব্যবসায়ীও এখন ১% কর মিটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মাল বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু এখানে সেই পণ্যের বিক্রির উপর রাজ্য কিছুই পাবে না।
অসমের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিগোষ্ঠীর প্রস্তাব হল, কম্পোজিশন স্কিমের আওতায় আসার জন্য ব্যবসার ঊর্ধ্বসীমা বছরে ৭৫ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় কোটি করা হোক। রাজ্যের মধ্যেই ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ তুলে ভিন রাজ্যেও পণ্য পাঠানোতে ছাড় দেওয়া হোক। ব্যবসায়ী, উৎপাদক বা রেস্তোরাঁ, সবার জন্য ব্যবসার উপর ত্রৈমাসিক ১% কর নেওয়া হোক। কোনও কোনও ক্ষেত্রে কর ০.৫% করার কথাও বলেছেন হিমন্ত। এই প্রস্তাবই গুয়াহাটির বৈঠকে গ্রহণ করা হতে পারে বলে খবর।
প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গের ছোট ব্যবসায়ীরাও তো এতে উপকৃত হবেন, তা হলে রাজ্যের আপত্তি কেন?
অর্থ কর্তাদের একাংশ জানাচ্ছেন, জিএসটি আসলে একটি ‘গন্তব্য-কর’। অর্থাৎ যেখানে পণ্য গিয়ে শেষ বিক্রি হয় সেখানে কর আদায় হয়। কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় যে রাজ্যের ব্যবসায়ী মাল পাঠাচ্ছেন, সেখানেই কর দিয়ে দেবেন। এ রাজ্যে তা বিক্রি হলেও রাজ্য কোনও কর পাবে না। পশ্চিমবঙ্গ মূলত গ্রাহক রাজ্য, উৎপাদক রাজ্য নয়। বিভিন্ন রাজ্য থেকে এখানে পণ্য আসে। অন্য রাজ্যে পণ্য যায় তুলনায় কম। ফলে এই খাতে বছরে প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা রোজগারের সুযোগ রয়েছে রাজ্যের। যা নতুন প্রস্তাবে মার খাবে।
এ ছাড়া, মনে করা হচ্ছে, কম্পোজিশন স্কিমে বছরে ব্যবসার ঊর্ধ্বসীমা দেড় কোটি করে দেওয়া হলে বহু ব্যবসায়ী এতে নাম লেখাবেন। অনেকে হয়তো কর ছাড়ের সুবিধা নিতে ব্যবসা ভাগ করে দেখাবেন। যা জিএসটির মূল ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সামিল। এতে রাজ্যে নতুন যে দেড় লক্ষ নতুন ব্যবসায়ী কর দিতে নাম লিখিয়েছেন, তাঁদেরও একটা বড় অংশ বেরিয়ে যাবেন। ফলে রাজ্যের নিজস্ব আয়ও মার খাবে।
কর কর্তাদের অনেকের ধারণা, গুজরাতের ব্যবসায়ীরা নোটবন্দি এবং জিএসটির ফলে বিজেপির উপর ক্ষুব্ধ। আসন্ন ভোটে বিজেপির এই চিরাচরিত ভোট ব্যাঙ্ক উল্টো পথে যেতে পারেন। ফলে জিএসটি-র চাপমুক্ত করতেই ঝঞ্ঝাটমুক্ত ‘কর’-এর ব্যবস্থা করছেন মোদী। যার খেসারত দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিষেবা ও গ্রাহককেন্দ্রিক রাজ্যগুলিকে।