Advertisement
E-Paper

কাশ্মীর: বাজপেয়ী যা পারতেন, মোদী পারেন না

মে ২০০২। কয়েক মাস আগে ভারতের সংসদে হামলা হয়ে গিয়েছে। সীমান্তের দু’পারে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করেছে ভারত ও পাকিস্তান। তটস্থ সারা বিশ্ব। যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুদ্ধ হলে তা হবে সর্বাত্মক। সেনার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে গিয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী।

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৭ ১৫:০০

মে ২০০২। কয়েক মাস আগে ভারতের সংসদে হামলা হয়ে গিয়েছে। সীমান্তের দু’পারে বিপুল সৈন্য সমাবেশ করেছে ভারত ও পাকিস্তান। তটস্থ সারা বিশ্ব। যে কোনও মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু হতে পারে। যুদ্ধ হলে তা হবে সর্বাত্মক। সেনার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখতে গিয়েছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ফিরে আসার পথে শ্রীনগর বিমানবন্দরে এক নাছোড় সাংবাদিকের মুখোমুখি তিনি। ‘‘আপনে কাহা কি সব সে বাত করেঙ্গে, তো ক্যা ইয়ে হোগি উইদিন দ্য কনস্টিটিউশন বাত?’’ একটু দাঁড়িয়ে গেলেন বাজপেয়ী, উড়ে এল সরাসরি উত্তর, ‘‘উসকি বাত কিউ করতে হ্যায়, হাম ইনসানিয়াৎ কে দায়রে মে বাত করেঙ্গে।’’ শুধু একটি বাক্য, বদলে দিল তৎকালীন কাশ্মীরের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি।
সারা কাশ্মীর জুড়ে এই বাক্যটি নিয়ে উদ্‌যাপন শুরু হয়ে যায়। যা হুরিয়ত কনফারেন্সের মতো কথা বলতে অনাগ্রহী, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকেও আলোচনায় এগিয়ে আসতে বাধ্য করেছিল। ধাপে ধাপে যার কৌশল রচনা করেছিলেন বাজপেয়ী ও তাঁর আস্থাভাজন আমলারা। ইতিহাস বলবে এই চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু কাশ্মীর আজও বাজপেয়ীর সেই চেষ্টাটিকে ভোলেনি।
বাজপেয়ী একটি সহজ সত্যকে বুঝেছিলেন। আলোচনা ছাড়া কাশ্মীর সমস্যার কোনও সমাধান নেই। আর কথা বলতে হবে সবার সঙ্গে, সবার সঙ্গেই। কাউকে বাদ দিলে চলবে না।
বাজপেয়ী যে ভরসার হাতটি বাড়িয়েছিলেন, বর্তমান মোদী জামানায় তা কোথাও হারিয়ে গিয়েছে। শুধু হারিয়েই যায়নি, বজ্রমুষ্টি হয়ে ফিরে এসেছে। এই হাত শুধু শক্তির কথা বোঝে। আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত বোঝে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক বোঝে। বাজপেয়ীর ‘ইনসানিয়াৎ’ তাতে ছিটেমাত্র নেই। ফল দেখুন। ক্রমেই কাশ্মীর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
কোনও বিচ্ছিন্নতাবাদী বা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না, যদি না তা স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন পায়। সেই সমর্থন এমনই জায়াগায় গিয়েছে যে, স্কুলের ছাত্রীরাও ভারতীয় সেনার দিকে পাথর ছুড়ছে। একটি রাজনৈতিক দাবি ক্রমেই ধর্মীয় রূপ পেয়ে যাচ্ছে। আল-কায়দা বা আইএস-এর মতো সংগঠন কাশ্মীর নিয়ে ধর্মযুদ্ধের ডাক দিচ্ছে। এর বদলে মোদীর কৌশল কী? আরও শক্তির প্রদর্শন।
এ কথা সত্য যে কাশ্মীরের এই টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরির পিছনে পাকিস্তানের, বিশেষ করে পাক-সেনা কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে দুই ভারতীয় সেনার মুণ্ডচ্ছেদের মতো বর্বরোচিত কাজ করতেও বাধেনি তাদের। কিন্তু এই আঘাত-প্রত্যাঘাতের গগনভেদী চিৎকারের মধ্যে আমরা ভুলে যাই কাশ্মীরের সাধারণ জনগণকে। তাঁদের বড় অংশ ভারত সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ। পাথরের বৃষ্টির আড়ালে এই মনটিকে বুঝতে ব্যর্থ মোদী। আর তাই ক্রমেই এঁরা দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে পাথর ছোড়াও কমছে না, আর এই সুযোগে আমেরিকা, তুরস্ক মধ্যস্ততা করার প্রস্তাব তোলার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।


দেড় দশক আগের সেই বৈঠক।

বাজপেয়ী বুঝেছিলেন, সবার সঙ্গে আলোচনায় বসলে বিচ্ছিন্নতাবাদের থেকে প্রাণবায়ু কেড়ে নেওয়া যায়। ফলে সন্ত্রাসবাদের শিকড় শুকিয়ে যায়। পাশাপাশি বাস্তববাদী হওয়াও দরকার। কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মানতে হবে, আলোচনার জন্য এই শর্তে আটকে থাকলে সমাধানের সন্ধান পাওয়া দূর অস্ত্। সমাধানের জন্য দু’পক্ষকে নমনীয় হতে হয়। আর দরকার কলজে ভরা সাহস।
বাজপেয়ী লাহৌর বাসযাত্রায় গিয়েছিলেন। যে প্রক্রিয়া বানচাল করতে তৎকালীন পাক সেনাপ্রধান মুশারফের প্রত্যক্ষ মদতে কারগিলের যুদ্ধ। তার পরে সংসদে আক্রমণ। এর পরেও পাকিস্তানের সঙ্গে শান্তির কথা, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতে গেলে সাহস দরকার। মোদীর কৌশলে সেই সাহস কোথায়? আমাদের বীর জওয়ানরা এক চুলও জমি ছাড়বেন না। কিন্তু তাঁদের এই বলিদানের পালা কবে শেষ হবে? এই অনন্ত রক্তস্রোতের পরেও মোদীর কাশ্মীর নীতি কি আদৌ কোনও মোকাম খুঁজে পেল?
আসলে মোদী শক্তির ভাষা বোঝেন। সেই ভাষায় ‘ইনসানিয়াৎ’-ধারণাটিই নেই। সেখানে আলোচনা শুরুর আশ্বাস মানেই দুর্বলতা প্রদর্শন। ৫৬ ইঞ্চির ছাতি কি আর তা করতে পারে? উন্নয়নের প্যাকেজ, কাশ্মীরের যুবকদের ‘টেররিজম ছেড়ে ট্যুরিজমে’ ফিরে আসার বার্তা দিয়েই ক্ষান্ত হয়ে যান।

আরও পড়ুন: কাশ্মীর সমস্যায় মধ্যস্থতা করতে চান এরদোগান, প্রস্তাবে না দিল্লির

সমস্যা আছে অন্যত্রও। বাজপেয়ীর মতো ছক ভেঙে এগিয়ে যাওয়া মোদীর অভিধানে নেই। বাজপেয়ীর কাছে আডবাণী, ব্রজেশ মিশ্রের মতো পরামর্শদাতারা ছিলেন। তিনি তাঁদের কথা শুনতেন। ‘লৌহপুরুষ’ আডবাণীই সেই ব্যক্তি যিনি সংসদে আক্রমণের পরে ভারত-পাকিস্তানের শীতল সম্পর্কের বাঁধ ভেঙেছিলেন তৎকালীন পাক হাইকমিশনারের সঙ্গে গোপনে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে। যা পরে আলোচনার দরজাটি খুলে দিয়েছিল। কিন্তু এই প্রশাসনে সবাই মোদীর কথা শোনেন। তাঁর আদেশ পালনেই সময়ে কেটে যায়। মোদীকে পরামর্শ দেওয়ার সময় কোথায়? আর পরামর্শ দিলে মোদী শুনবেন এমন আশ্বাস চরম আস্থাভাজনও দিতে পারবেন না। বরং ফল হতে পারে উল্টো। অতএব ভজনায় ব্যস্ত থাকাই নিরাপদ। ফলে কাশ্মীর আটকে থাকে অগ্নিবলয়ের মধ্যেই।
বাজপেয়ীর কাশ্মীর নীতি নিয়ে বই লিখেছেন ‘র’-এর প্রাক্তন প্রধান এ এস দুলত। সেই বই শেষ হয়েছে এক আশ্চর্য উক্তিতে। এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা দুলতকে তাঁদের আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য দায়ী করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘আপনার কাছে আছে আমাদের আন্দোলন নষ্ট করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র, আলোচনা।’’

Narendra Modi Pervez Musharraf Atal Bihari Vajpayee Kashmir
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy