এত দিন ছিল রাজনৈতিক জল্পনা। কখনও তাঁর টুইট, কখনও অন্য প্রসঙ্গে করা কোনও মন্তব্য, কখনও বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর বাক্যালাপ কিংবা দলীয় সভায় দেওয়া নির্দেশ থেকেই পড়ে নিতে হয়েছে ইঙ্গিত।
সেই ইঙ্গিতকেই শুক্রবার সোজাসাপ্টা ভাষায় প্রকাশ করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এনডি়টিভি ইন্ডিয়ার সম্প্রচার বন্ধ করা থেকে শুরু করে একশো দিনের কাজের টাকা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো কিংবা মধ্যপ্রদেশে সিমি-র ৮ বিচারাধীন সদস্যের সংঘর্ষে মৃত্যু— নানা ঘটনায় বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতা করলেন তৃণমূল নেত্রী। সেই প্রসঙ্গেই বলে দিলেন, ‘‘আমি তো একাই লড়ে যাচ্ছি! তবে বিরোধীরা একসঙ্গে কোনও মঞ্চ করলে আমি সঙ্গে আছি। যে কোনও ভূমিকা নিতে রাজি।’’
নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার সুর বহু দিন ধরেই চড়িয়ে রেখেছেন মমতা। কখনও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে তুলেছেন রাজ্যকে বঞ্চনার অভিযোগ, কখনও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘনের, কখনও প্রতিহিংসার রাজনীতির। বিজেপিকে ঠেকাতে তিনি অতীতে আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে ফেডারেল ফ্রন্ট গড়তে উদ্যোগী হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আবার দেখা দিয়েছে সেই জল্পনা।
নানা প্রশ্নে মমতার গলায় কেন্দ্র-বিরোধী সুর শুনে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, এক দিকে কংগ্রেস এবং অন্য দিকে মুলায়ম-লালুপ্রসাদ-নীতীশ কুমারদের মতো আঞ্চলিক শক্তিকে একজোট করে বিজেপির বিরুদ্ধে ফের ধর্মনিরপেক্ষ জোট গড়ে তুলতে চান মমতা। সম্প্রতি দলীয় বৈঠকেও তৃণমূল নেত্রী মেনে নেন, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে কোনও ধর্মনিরপেক্ষ জোট গড়া অসম্ভব। পাশাপাশি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্ঘটনার পর তাঁর খবর নিতে মমতাকে ফোন করেন রাহুল গাঁধী। খবর নেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারও।
পুরনো জল্পনা মাথাচাড়া দিয়েছিল তখনই। তা বাড়িয়ে দেয় দিন দুয়েক আগে মমতার টুইট। পেনশন নিয়ে আশ্বাসপূরণ না হওয়ায় প্রাক্তন সেনা জওয়ানের আত্মহত্যার পর রাজধানীতে যে ভাবে রাহুল গাঁধী এবং অরবিন্দ কেজরীবালকে আটক করা হয়েছিল, তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন মমতা। এ দিন তাঁর অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘন করছে মোদী সরকার। নইলে একশো দিনের কাজের প্রকল্প নিয়ে কী ভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কথা বলেন মুখ্যসচিবের সঙ্গে? এর সঙ্গে রয়েছে মধ্যপ্রদেশের ঘটনা। বিরোধীদের একাংশ ভুয়ো সংঘর্ষের দিকে ইঙ্গিত করেছেন ইতিমধ্যেই। এ দিন মমতাও বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে বলেছেন, সিবিআইয়ের তদন্তে আস্থা নেই।
কংগ্রেস ও সিপিএম অবশ্য মনে করছে, একের পর এক প্রকল্পে কেন্দ্র যে ভাবে আর্থিক বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে, তাতে সরকার চালাতে নাজেহাল মমতা। তাঁর এখন পাল্টা কৌশল, বিজেপি-বিরোধী সব দলকে এক সঙ্গে নিয়ে সংসদের আসন্ন অধিবেশন পণ্ড করা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী এবং বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের দাবি, মমতার ‘কংগ্রেসপন্থী’ মনোভাব লোক দেখানো! বাম পরিষদীয় দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী এবং শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্যের যুক্তি, মোদী সরকার এখন বিভিন্ন প্রকল্পে দেওয়া টাকা খরচের হিসেব চাইছে। কিন্তু রাজ্য এখনই হিসেব দিতে নারাজ। সেই সঙ্গে সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের বিষয়টিও রয়েছে।
মান্নানের কথায়, ‘‘গত পাঁচ বছরে তৃণমূল কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্যের কোটি কোটি টাকা বেহিসেবি খরচ করেছে। কেন্দ্র যাতে তা নিয়ে প্রশ্ন না তোলে, তাই মমতা বিজেপির উপরে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছেন!’’ অধীরের মতে, ‘‘মমতা কংগ্রেসের জুজু দেখিয়ে বিজেপিকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছেন। কংগ্রেসের প্রতি উনি নরম বলে কেউ যদি মনে করেন, তিনি ভুল করবেন!’’ যদিও সদ্য তৃণমূলে যাওয়া মানস ভুঁইয়ার কটাক্ষ— ‘‘এঁরা দু’জন বঙ্গীয় কংগ্রেসের কালিদাস!’’
সিপিএমের সুজনবাবুর মন্তব্য, ‘‘যিনি আজও গুজরাত দাঙ্গার নিন্দা করেননি, তিনি যে মোদীর পক্ষেই থাকবেন, এটা নতুন কিছু নয়। আসলে তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি নিয়ে কেন্দ্রের মুখ বন্ধ রাখতেই মমতার গলায় বিজেপির সমালোচনা!’’ আর অশোকবাবুর মতে, ‘‘এক দিকে কেন্দ্রের দেওয়া টাকা খরচের হিসেব, সঙ্গে বিপুল দেনা শোধের চাপ। এই দুই চাপ মোকাবিলা করতেই মমতা পাল্টা চাপ দিচ্ছেন মোদীর উপরে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy