Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

সোজা ব্যাটেই খেলতে চান নতুন পুরপ্রধান

লোকে তাঁকে বদমেজাজি বলেন বটে, তবে তিনি তা মানেন না। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘আসলে আমি স্পষ্ট কথা শুনতে চাই। কম কথায় আসল বিষয়। ইনিয়ে বিনিয়ে কেউ কথা বললে বিরক্ত লাগে।’’ এমনই স্পষ্টবক্তা শিলচরের প্রবীণ আইনজীবী নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর। আগামী কাল শিলচরের পুরপ্রধান হিসেবে শপথ নেবেন তিনি। তার আগে আজ আনন্দবাজারের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক সোজা-সাপটা কথা বললেন নীহারবাবু।

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫৫
Share: Save:

লোকে তাঁকে বদমেজাজি বলেন বটে, তবে তিনি তা মানেন না। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘আসলে আমি স্পষ্ট কথা শুনতে চাই। কম কথায় আসল বিষয়। ইনিয়ে বিনিয়ে কেউ কথা বললে বিরক্ত লাগে।’’ এমনই স্পষ্টবক্তা শিলচরের প্রবীণ আইনজীবী নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর। আগামী কাল শিলচরের পুরপ্রধান হিসেবে শপথ নেবেন তিনি। তার আগে আজ আনন্দবাজারের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক সোজা-সাপটা কথা বললেন নীহারবাবু।

সকাল ন’টায় বাড়ির বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলেন। দলীয় সমর্থক কিংবা অনুরাগীদের ভিড় দূরে থাক এই এক ঘণ্টায় শুভেচ্ছা জানাতে বা দাবিপত্র নিয়েও হাজির হননি তাঁর কাছে। একবার শুধু বিজেপি নেতা শশাঙ্কশেখর ধর একবার এলেন। পুরপ্রধান পদের জন্য প্রয়োজনীয় মনোনয়ন পত্র পূরণ করা হয়েছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করলেন। মিনিট পাঁচেকও বসেননি। এর মধ্যে বজরং দলের তরফে থেকে চাঁদা চাইতে গিয়েছিল একটি দল। উঠোনে দাঁড়িয়েই চাঁদা নিয়ে তারাও চলে গেল। আসলে এই সবই ওই ‘বদমেজাজি’ ধারণার ফল। নীহারবাবুর কথায়, ‘‘এতে আমার লাভই হয়েছে। আমাকে ঘিরে কোনও উপদল তৈরি হবে না কখনও। ভিড় করবেন না স্বার্থান্বেষীরাও। এমনকী পুর সদস্যরাও কাজে-অকাজে চেয়ারম্যানের অফিসে বসে আড্ডা দেবেন, তা হবে না। অফিসে কাজ করতে হবে। যেমন কর্মীদের, তেমনই চেয়ারম্যানকেও। নিয়মিত জনসাধারণের সমস্যা শুনতে হবে।’’

এ বার শিলচর পুরপ্রধানের পদটি তফশিল জাতির জন্য সংরক্ষিত। সে কথা মাথায় রেখেই দল নীহারবাবুকে পুর নির্বাচনে প্রার্থী করেছিল। তিনি জেতায় পুরপ্রধানের পদে দ্বিতীয় আর কোনও নাম আসেনি। কিন্তু সমস্যা ছিল উপ-প্রধান পদে। অনেকেরই নজর ছিল ওই চেয়ারের দিকে। ২৮ আসনের পুরসভায় বিজেপির শক্তি ১৭। মহিলা ১১, পুরুষ ৬। দল মহিলাদের মধ্য থেকে উপ-প্রধান করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আগেই দাবিদার কমিয়ে দেয়। পরে আলোচনার ভিত্তিতে আরেক আইনজীবী, চামেলি পালকে উপ-প্রধান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দু’জনেই এই প্রথম পুরসভায় নির্বাচিত হলেন। এর মধ্যে চামেলিদেবী সংগঠনেও নতুন মুখ। তবে নীহারবাবুর কাছে এ সব কোনও সমস্যা নয়। তিনি বলেন, ‘‘কাজের ইচ্ছেটাই হল আসল। বাকিটা দু-দিন আগে-পরে ঠিক হয়ে যায়। টিম-নীহারেন্দ্রতে দুই প্রাক্তন উপ-প্রধানও রয়েছেন। একজন বীজেন্দ্রপ্রসাদ সিংহ, অন্যজন মিত্রা রায়। তবে সেটাও নীহারবাবুর কাছে কোনও সমস্যা নয়। তাঁর দাবি, ‘‘বরং তাঁদের অভিজ্ঞতাকে আমরা কাজে লাগাতে পারব।’’

এই প্রথম শিলচর পুরসভার নির্বাচিত সদস্য হলেও ৭৩ বছরের নীহার ঠাকুর (এই নামেই তিনি শহরে পরিচিত) বিজেপি করেন সংগঠনের জন্মলগ্ন থেকেই। বাবা নিতাইচাঁদ পাটনি ছিলেন বরাক উপত্যকায় তফশিল জাতিভুক্ত প্রথম আইনজীবী। এবং শিলচর মহকুমার প্রথম তফশিল স্নাতক। তফশিল সম্প্রদায়ের সঙ্গে বঞ্চনার অভিযোগ এনে বার বার তিনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন। ছোট ভাই নিশীথ ১৯৬১-র ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়েছিলেন। নীহারবাবু নিজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ এবং এলএলবি।

তাঁর কাছে বোর্ড পরিচালনা নয়, নাগরিক যন্ত্রণাই এক এবং একমাত্র সমস্যা। প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা সন্তোষমোহন-জায়া বীথিকা দেবের মত তিলোত্তমা গড়ার স্বপ্ন দেখেন না। পুর সমস্যার সমাধান তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পাবে। শপথ গ্রহণের আগের দিন মূল সমস্যাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথাই শোনান নীহারবাবু। জমা জল নিকাশির ব্যবস্থা করা, জঞ্জাল পরিষ্কার, পানীয় জল সরবরাহ এবং পুর এলাকার রাস্তাগুলির উন্নয়ন। সব ক্ষেত্রেই আর্গের বোর্ড দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বলেই তিনি মনে করেন। তাঁর প্রাথমিক পরিকল্পনা, যে পথে শহর থেকে জল বেরিয়ে যায়, সেই নিকাশি ব্যবস্থা নিয়মিত সাফ-সুতরো রাখবেন। যে সব জায়গায় নালা আটকে রাখা হয়েছে বা জবর দখল হয়েছে, সেগুলিকে পুনরুদ্ধার করে স্বচ্ছন্দে জল যাওয়ার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়, সকালে মানুষজন বাজারে বের হওয়ার আগেই দিনের জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজ সেরে নিতে চাইছেন নীহারবাবু। এ ব্যাপারে পুরসভার যুক্তি ছিল, পুরসভার শ্রমিকরা বিভিন্ন জায়গায় থাকেন। ভোরে তাঁদের পক্ষে পুরসভায় এসে পৌঁছনো সম্ভব হয় না। নীহারবাবু এই অজুহাত মানতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘শ্রমিকদের কাজ করতে হলে কাজের শর্ত মেনেই চলতে হবে। ভোরে আসতে না পারলে শহরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।’’ নইলে শহর থেকেই শ্রমিক নেবেন তিনি। তৃতীয়ত, পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে নতুন জলপ্রকল্প স্থাপনের জন্য সরকারের উপর চাপ তৈরি করবেন। তবে সবার আগে পাম্প দিয়ে পাইপ থেকে জল টেনে নেওয়া বন্ধ করবেন তিনি। সে জন্য দায়িত্ব নিয়েই তিনি বিদ্যুৎকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। আর তিনি চাইছেন পুরসভার রাস্তাগুলি চলাচলযোগ্য হয়ে উঠুক। তাঁর অভিযোগ, ‘‘বহু গলিতে হাঁটাই যায় না।’’

ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পুলিশি অভিযানের সমর্থক নীহারবাবু। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পৃথক বাজার গড়া হবে।’’

পুরসভার আর্থিক উৎস মূলত তিনটি—পুর রাজস্ব, রাজ্য সরকারের বরাদ্দ ও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় অর্থও রাজ্যের মাধ্যমেই পুরসভার হাতে আসে। রাজ্যে এখন কংগ্রেস সরকার। তবে তাতেও উদ্বিগ্ন নন বিজেপি নেতা নীহারবাবু। মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের উপদেষ্টা বরাকের কংগ্রেস নেতা গৌতম রায়কে খোলাখুলিই ‘ভাল লোক’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘গৌতমবাবুর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি সব ধরনের সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন।’’ নীহারবাবু নিশ্চিত, স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ প্রজেক্টের দরপত্র আহ্বান ও কাজ বণ্টনের পর যে ফাইলটি এখন রাজ্য সরকারের কাছে আটকে রয়েছে, তাঁর অনুরোধে সেটিও গৌতমবাবু ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। তবে সাংসদ সুস্মিতা দেবের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তিনি বিশ্বাস করেন, তাঁকেও পাশে পাবেন। নীহারবাবুর কথায়, ‘‘এই পুরসভায় সুস্মিতার ঠাকুর্দা সতীন্দ্রমোহন দেব, বাবা সন্তোষমোহন দেব, মা বীথিকা দেব এবং তিনি নিজে চেয়ারপার্সন ছিলেন।’’ সুতরাং রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠেই সাংসদ সুস্মিতা সাহায্য করবেন বলে আশা করছেন তিনি।

শপথ গ্রহণের আগে কোনও বিষয়কেই কি সমস্যা বলে মনে করেন না নীহার ঠাকুর। ‘বদমেজাজি’ মানুষটি একটু থমকালেন। তারপর বললেন, ‘‘বিশ্বাস করে বিরাট গুরুদায়িত্ব মানুষ আমার কাঁধে তুলে দিয়েছে। এরই পাশাপাশি, ব্যক্তিগত জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে আমাকে নিয়মিত আদালতেও যেতে হবে। ভাবছি, এক দিকে জনগণ, অন্য দিকে জীবিকা, দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করে চলতে পারব তো!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE