জমি আইন সংশোধন তাঁর কাছে ‘জীবন-মরণের বিষয় নয়’ বলে দাবি করেও, মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে তৃতীয় বারের জন্য এ ব্যাপারে অর্ডিন্যান্স তথা অধ্যাদেশ জারির অনুমোদন দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছুটি-উত্তর পর্বের রাহুল গাঁধীও বজায় রাখলেন মোদীকে আক্রমণের ধারাবাহিকতা। মন্ত্রিসভা অধ্যাদেশে অনুমোদন দিয়েছে, জানা মাত্রই টুইট শানিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, ‘‘গরিব চাষিদের জমি কেড়ে নিতে আশ্চর্যরকম তাড়ায় রয়েছেন মোদীজি। কিন্তু কৃষক ও মজুরদের অধিকারের জন্য কংগ্রেস লড়াই চালিয়ে যাবে।’’
গত ছ’মাসের মধ্যে জমি আইন সংশোধনের জন্য দু’বার অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। তার মাধ্যমে মূলত শিল্প করিডর, শহর ও গ্রামে পরিকাঠামো নির্মাণ, প্রতিরক্ষা কারখানা, আবাসন ও সামাজিক পরিকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের ক্ষমতা সরকারের হাতে রাখতে চেয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু দু’বারই আইন সংশোধনের সেই বিল সংসদের চৌকাঠ পার করতে পারেনি। বিরোধীদের একরোখা আপত্তিতে গোঁত্তা খেয়ে ধরাশায়ী হয়েছে। বিল পাশ করানোর পথ খুঁজতে শেষমেশ বিরোধীদের দাবি মতো সংসদীয় যৌথ কমিটির কাছে বিলটি পাঠাতে হয়েছে সরকারকে। উপরি পাওনা, কৃষক-বিরোধী তকমা। সরকারের জমি নীতিকে সামনে রেখে যা মোদীর গায়ে সেঁটে দেওয়ার ধারাবাহিক চেষ্টা চালাচ্ছেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধী। এবং ইতিমধ্যেই বেশ খানিকটা সাফল্য পেয়েছেন এ ব্যাপারে। সঙ্গে মোদী সরকারকে লাগাতার ‘স্যুট বুটের সরকার’ বলেও বিঁধে চলেছেন কংগ্রেস সহসভাপতি।
এই পরিস্থিতিতেও আজ ফের জমি আইন সংশোধন অধ্যাদেশে অনুমোদন দিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা! ঠিক তার আগেই একটি সংবাদপত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদী বললেন, ‘‘জমি (আইন সংশোধনের) বিলটি আমার কাছে জীবন-মরণের বিষয় নয়। সরকার বা বিজেপির কর্মসূচিও নয় সেটা। কিছু রাজ্য সরকার বর্তমান আইন সম্পর্কে উদ্বেগ জানিয়ে এর বদল চাইছিল। যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রধান হিসেবে সেই উদ্বেগ প্রশমনেরই চেষ্টা করেছি মাত্র।’’ এবং সেই সঙ্গে ফের দাবি করেছেন মোদী, ‘‘প্রস্তাবিত জমি আইনের কোনও অংশই কৃষক- বিরোধী নয়।’’ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ‘জীবন-মরণের ব্যাপার’ যদি না-ই হয়, তবে ফের কেন এই অধ্যাদেশ? প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে কি স্ববিরোধই ধরা পড়ছে?
বিজেপি নেতারা বলছেন, অধ্যাদেশ জারি করা ছাড়া অন্য পথ ছিল না সরকারের সামনে। ইউপিএ জমানায় নতুন জমি আইন প্রণয়নের সময় বলা হয়েছিল, ১ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে রেল, জাতীয় সড়ক নির্মাণ, পরমাণু প্রকল্প-সহ ১৩টি ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের জন্য যে আলাদা আইন রয়েছে, তার বিলোপ হবে। এবং এই সব ক্ষেত্রে মূল জমি আইনের মতোই ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের শর্ত প্রযোজ্য হবে। তাই অধ্যাদেশ জারি না করলে ওই ১৩টি ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তবে শাসক দল এ-ও বুঝতে পারছে, আম-জনতা এই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার খুঁটিনাটি বুঝবে না। তারা কেবল অধ্যাদেশ জারি করাটাই দেখবে। এটা ঘটনা যে, ওই অধ্যাদেশের আড়ালে মূল জমি আইনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বদলও আনছে সরকার। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে জমি মালিকদের সম্মতি নেওয়া ও সামাজিক সমীক্ষা চালানোর শর্ত তুলে দেওয়া যেগুলির অন্যতম। এবং এটাই মূলত এককাট্টা করে তুলেছে বিরোধীদের। অধ্যাদেশের এই দিকটি নিয়ে সংসদীয় ও রাজনৈতিক স্তরে বিরোধিতা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, কংগ্রেস মানুষের মনে একটি ধারণা গেঁথে দেওয়ার উপরে বিশেষ জোর দিচ্ছে। তা হল, বাছা বাছা কিছু পুঁজিপতির স্বার্থ পূরণে সরকার এতটাই মরিয়া যে তার জন্য বারবার অধ্যাদেশ জারি করতেও পিছপা নয়। এবং রাহুল আজ ঠিক সেই কাজটাই করেছেন।
সরকারের জমি নীতি নিয়ে শুধু বিরোধীদের নয়, শরিকদের, এমনকী বিজেপি ও সঙ্ঘের একাংশেই আপত্তি রয়েছে। তাই কৌশলে কিছুটা বদল ঘটিয়েছেন মোদীও। সরকার ও বিজেপি, দুইয়ের ঘাড় থেকেই জমি আইন সংশোধনের দায়টা ঝেড়ে ফেলতে তৎপর এখন তিনি। সাক্ষাৎকারে মোদী তাই জানিয়েছেন, জমি আইন সংশোধন আদতে তাঁর বা তাঁর দলের মাথাব্যথাই নয়। রাজ্যগুলির সমস্যাই মেটাতে চেয়েছেন তিনি। স্যুট-বুটের সরকার বলে তাঁর বিরুদ্ধে যে প্রচার রাহুল গাঁধী চালাচ্ছেন তার জবাবও দিয়েছেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘স্যুটকেসের চেয়ে স্যুট ও বুট ঢের বেশি গ্রহণযোগ্য। ষাট বছর দেশ শাসন করে এখন গরিবের কথা মনে পড়েছে কংগ্রেসের।’’ ইউপিএ জমানার কেলেঙ্কারিগুলির দিকে আঙুল তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘স্পেকট্রাম ও কয়লা খনি বণ্টনে কি গরিবের লাভ হয়েছিল? বেছে বেছে কিছু শিল্পপতি ও ঠিকাদারকে বরাত দেওয়া হয়েছিল।’’
এই আক্রমণের জবাবে কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা আজ বলেন, ‘‘স্যুটকেসের ব্যাপারটা বিজেপি ভুলবে কী করে? যে দলের সভাপতি ঘুষ নিতে গিয়ে হাতেনাতে ক্যামেরায় ধরা পড়েন, স্যুটকেস তাদের ভূতের মতোই তাড়া করার কথা।’’
ছুটি থেকে ফিরে ইস্তক রাহুল তাঁর রাজনেতিক আক্রমণে শ্লেষ ও রসিকতার একটা নয়া রসায়ন তৈরি করতে চাইছেন। লোকসভা ভোটের আগে মোদী যা করতেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দক্ষতায়। কখনও সাহাবজাদা, কখনও শাহজাদা আখ্যা দিয়ে কটাক্ষ করতেন রাহুলকে। এখন আবার সেই ঘরানায় ফিরে রাহুলের আক্রমণকে মজার খোরাক করে তুলতে চাইছেন মোদী। বলেছেন, ‘‘মাঝে মাঝে ভাবি একটা বই লেখাব। বিরোধীরা আমার সম্পর্কে কী কী সমালোচনা করেছে তা নিয়ে। আসলে ওরা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। ওদের অভিযোগগুলি কী? এক, মোদী উদ্ধত। দুই, মোদী জমানায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় শক্তিশালী হয়েছে। আর তিন নম্বর আলোচনার বিষয়, মোদীর পোশাক-আশাক। আর যা-ই হোক মোদী জমানায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারবে না ওরা।’’ তরজায় এর পরে কংগ্রেসের মুখপাত্র সুরজেওয়ালার সংযোজন, ‘‘এদিক ওদিক কথা ঘুরিয়ে প্রধানমন্ত্রী আর পার পাবেন না। কালই তিনি বলেছিলেন, সরকার কৃষকদের পরামর্শ মেনে নেবে। পর দিনই কথার খেলাপ করে অধ্যাদেশে সায় দিলেন। জবাবটা কৃষকরাই দেবেন।’’
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র চাপাউতোর শুরু হয়ে গেলেও এটিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অনুমোদন নেওয়া এখনও বাকি। জমি নিয়ে প্রথম অধ্যাদেশটি প্রথম বারেই সই করেননি রাষ্ট্রপতি, ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন সরকারের কাছে। সে কথা মাথায় রেখেই কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ আজ জানিয়েছেন, নয়া অধ্যাদেশে সই না করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আর্জি জানাবেন তাঁরা। দু’তরফেই হাতে সময় অবশ্য কয়েক ঘণ্টা। কাল বেলা বারোটায় বিদেশ সফরে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। ফিরবেন ৫ জুন। দ্বিতীয় অধ্যাদেশটির মেয়াদ ফুরোচ্ছে তার দু’দিন আগেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy